ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে নারী ইউপি সদস্যকে 'জুতাপেটা' হতে হয়েছে- সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি দেখার পর থেকে একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছি। এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা?

জানা যায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি উচাখিলা ইউনিয়ন পরিষদে সদস্যদের নিয়ে সরকারি একটি প্রকল্পের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বৈঠকে বসেন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হাসান খান সেলিম। সভায় চেয়ারম্যান নিজে ৫০ শতাংশ ও মেম্বারদের ৫০ শতাংশ টাকা দিতে চান। কিন্তু মেম্বাররা ৭০ শতাংশ দাবি করলে চেয়ারম্যান রাজি হননি। ওই সময় ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রোকসানা আক্তার প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান তাঁকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। এ নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে নারী সদস্যকে মারধর করেন চেয়ারম্যান।

একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন আরেকজন জনপ্রতিনিধির গায়ে হাত তোলে, তখন বুঝতে হবে সেখানে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। আর তা যদি হয় নারী জনপ্রতিনিধির গায়ে হাত তোলা, তাহলে নিন্দা কী বলব, সে ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না। এ ধরনের ঘটনা সমাজের জন্য ভালো বার্তা দেয় না। আমাদের সমাজে যে পচন ধরেছে, এর বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে একজন পুরুষ জনপ্রতিনিধি কর্তৃক তাঁর নারী সহকর্মীর গায়ে হাত তোলা। এ ধরনের গুন্ডামি করার জন্য জনগণ ভোট দিয়ে কাউকে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেনি।

বস্তুত কোনো নাগরিকই আরেকজন নাগরিকের শরীরে আঘাত করতে পারে না। সেখানে জনতার নির্বাচিত প্রতিনিধি হলে তাঁদের আরও পরীক্ষিত হতে হয়। কারণ, তাঁদের আচরণ থেকে স্থানীয়রা শিক্ষা নেন। তাঁরা যদি অপরাধপ্রবণ হন তাহলে ভোটাররা তথা সেবাপ্রত্যাশীরা হতাশা ছাড়া আর কী আশা করতে পারেন! আমরা দেখছি, নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেও হয়রানি ঠেকানো যাচ্ছে না।

এটাও মনে রাখতে হবে- ময়মনসিংহে নারী সদস্যকে যেভাবে মারধর করা হয়েছে তা সারাদেশে নারী জনপ্রতিনিধি হেনস্তার খণ্ডচিত্র। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনে নারী জনপ্রতিনিধি নিশ্চিত করা হলেও তাঁরা যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কাছে দুর্বল- এর উদাহরণ ময়মনসিংহের ঘটনা। শুধু আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঠেকানো যাবে না। বিচার করে শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেলে অন্য অপরাধীরা সতর্ক হবে। প্রশিক্ষণের প্রতিও জোর দিতে হবে। বিশেষত পুরুষ সহকর্মীদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। না হলে পচনের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করা যাবে না।

ঈশ্বরগঞ্জের ঘটনায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, এমন একটি খবরও সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। ঘটনার এক দিন পর ৪ ফেব্রুয়ারি ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী নারী ইউপি সদস্য। তাঁকেই কেন মামলা করতে হবে? উচিত ছিল প্রশাসনেরই স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করা।


যা হোক, যখন এ নিবন্ধ লিখছি তখন পর্যন্ত ময়মনসিংহে অভিযুক্ত চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, পুলিশ বলছে, আসামি 'পলাতক'। একজন নারীর গায়ে হাত তুলে জঘন্য অপরাধ করেও তিনি এভাবে পালিয়ে থাকতে পারছেন মানে, সমাজের একটি অংশ তাঁকে সহায়তা করছে। আর তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারে এত সময় লাগবে কেন? সংশ্নিষ্টরা কি যথেষ্ট আন্তরিক?

আসলে এসব অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনতে থানা পুলিশ শক্ত অবস্থান নিতে পারে, আবার নাও নিতে পারে। ময়মনসিংহের ওই চেয়ারম্যানের ব্যাপারে কী হবে, আমি জানি না। তবে চেয়ারম্যান যদি প্রভাবশালী হন তাহলে এসব আইনি বা প্রশাসনিক ঝামেলা তিনি 'মিটিয়ে' ফেলতে পারেন। আর যদি তুলনামূলক কম প্রভাবশালী হন তাহলে আইনের আওতায় আনা যেতে পারে। বিষয়টি আরও বেশি নির্ভর করে সংশ্নিষ্ট থানার ওসির ওপর। অর্থাৎ ওসি যদি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন, সৎ ও সাহসী হন, তাহলে অভিযুক্ত যতই শক্তিশালী হোন না কেন, তাঁকে আইনের আওতায় আসতে হবে। আর ওসি যদি এর উল্টো হন তাহলে কী হতে পারে তা সবারই কমবেশি জানা। আসলে আমাদের পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা দরকার। এ রকম অভিযোগ আসার পর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করে তদন্ত করা জরুরি। না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলেও মাঝেমধ্যে পুরুষ সহকর্মী দ্বারা নারী সহকর্মী হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতেও নারী প্রতিনিধি পুরুষ প্রতিনিধির রোষানলে পড়ে থাকতে পারেন। এসব বিষয়েও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নারীর প্রতি পুরুষের রোষানলের সংস্কৃতি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়। সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো পুরুষ সহকর্মীর নারীকে সমমানের মানতে কষ্ট হয়। নারী অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাদের বেশি মারমুখী হতে দেখা যায়। ময়মনসিংহে ওই ইউপি চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পোষণ করেছেন ভিন্নমত পুরুষ জনপ্রতিনিধিরাও। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নারী সদস্যের দিকেই মারমুখী হয়েছেন চেয়ারম্যান।

মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। এসব নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু তা কখনোই মারামারি বা গালাগালে রূপ পেতে পারে না। জাতীয় সংসদে বিতর্ক হয়। ইউনিয়ন পরিষদ তো স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সংসদের মতোই। এখানে সদস্যরা ভিন্নমত পোষণ করবেন। চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত তাঁদের পছন্দ না হলে আপত্তি দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। চেয়ারম্যান যুক্তি দিয়ে বাস্তবতা তুলে ধরবেন। তিনি কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা আঘাত করার অধিকার রাখেন না। ভাগবাটোয়ারা করে নিজেদের ভাগ্য বদলকারীদের দিয়ে জনগণের উপকার হয় না। দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়াই উত্তম। তার আগে জরুরি- গায়ে হাত তোলার মতো ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা।

প্রসঙ্গত বলি, সংরক্ষিতের মধ্যে আটকে না থেকে নারীদের আরও বেশি প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দরকার। রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি নিশ্চিত করা দরকার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সদিচ্ছার অভাবে এটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কেউ কেউ বলেন, যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যাওয়ায় এটা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। আমি তো দেখি, পুরুষের তুলনায় কোনো কোনো নারী ভালো করছেন। নারীদের মধ্যে মাস্তানির প্রবণতা কম। স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি হিসেবে এমন অনেক নারী নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁরা কোনো কোনো সংসদ সদস্যের চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন ও সক্রিয়। আসলে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবেই ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি নিশ্চিত হচ্ছে না। যদি রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকত তাহলে এটি উপেক্ষিত থাকতে পারত না।

মনে রাখা জরুরি- নারীদের উপেক্ষা করে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে শুধু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলেই হবে না। সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বক্ষেত্রে তাঁদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

খুশী কবির: সমন্বয়ক, নিজেরা করি