ভয়ংকর প্রাণঘাতী ভাইরাস কভিড-১৯ পরিস্থিতি আর বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যজনিত জরুরি অবস্থা নহে বলিয়া ডব্লিউএইচও তথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেই ঘোষণা দিয়াছে, উহা নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক। সংস্থাটির মহাসচিব টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস কভিড-১৯ সংক্রান্ত জরুরি কমিটির পঞ্চদশ সভার সুপারিশ অনুসারে শুক্রবার জানাইয়াছেন, এখন হইতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্ব স্ব পদ্ধতি ও নিয়মে এই ভাইরাসজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করিবে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত এই জরুরি অবস্থার অবসান অবশ্য এমন সময় হইল, যখন কার্যত অনেক দেশে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়া আসিয়াছে। তথাপিও গত তিন বৎসরে কভিড-১৯ ভাইরাস ও এই সংক্রান্ত জটিলতায় প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাইবার পর এই ঘোষণায় হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিবার ফুরসত মিলিবে। ডব্লিউএইচওর ঘোষণা ও নির্দেশনা অনুসরণ করিয়া করোনা অতিমারির সূচনা হইতেই স্বাস্থ্যবিধি প্রণয়ন ও প্রতিপালন করিয়া আসা বাংলাদেশও উহার ব্যতিক্রম নহে।

স্মরণে রাখিতে হইবে, এইরূপ ঘোষণার অর্থ ইহা নহে যে করোনাভাইরাস বিদায় লইয়াছে। এই ভাইরাসজনিত রোগ এখন বিবেচিত হইবে শ্বাসযন্ত্রের একটা সাধারণ রোগ হিসাবে। ফলে অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেই প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনা করা যায়, এই রোগও সেই প্রক্রিয়াতেই ব্যবস্থাপনা করা যাইবে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্ব অর্থনীতির সহিত অতীতের যেই কোনো সময় অপেক্ষা অধিকতর সংযুক্ত এবং প্রবাসী আয় এখানকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখিয়া থাকে, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে আকসার বিদেশে যাইতে হয়; কিন্তু করোনাকালে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞার কারণে আর যাই হউক বিদেশ ভ্রমণ সহজসাধ্য ছিল না– ডব্লিউএইচওর উক্ত ঘোষণার কারণে বিদেশ ভ্রমণের উপর এখনও আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসমূহ উঠিয়া যাইবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। সর্বোপরি, করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বরাদ্দকৃত রাষ্ট্রীয় অর্থেরও সাশ্রয় হইবে। উপরন্তু, এ সময়ে অবকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবল বিষয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে উন্নতি ঘটিয়াছে, উহা অন্য রোগ মোকাবিলায় কাজে লাগিবে।

ডব্লিউএইচওর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অনুসারে, বিশ্বে এই অতিমারিতে ৭০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, যদিও ইহার মহাসচিব মনে করেন সংখ্যাটা দুই কোটির কম হইবে না। বাংলাদেশে সরকারি তথ্য অনুসারে, অদ্যাবধি ২৯ সহস্রের অধিক মানুষ এ রোগে প্রাণ হারাইয়াছেন। দেশ ও বিদেশে করোনায় মৃত্যুবরণকারী স্বজনদের প্রতি রইল আমাদের গভীর সমবেদনা। আমরা জানি, প্রতিটা বিপদ ক্ষতির কারণ হইবার পাশাপাশি মূল্যবান শিক্ষাও রাখিয়া যায়। করোনাও তেমনি আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রাখিয়া গিয়াছে। এই অতিমারির পূর্বে জনসাধারণের ব্যাপক অংশের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিশেষত হস্ত জীবাণুমুক্তকরণ এবং মুখে মাস্ক পরিধানের বিষয়ে সচেতনতা ছিল না বলিলেই চলে। আমাদের বিশ্বাস করোনাকালীন এ স্বাস্থ্যবিধি চর্চা ভবিষ্যতে বহু সংক্রামক রোগের আক্রমণ হইতে মানুষকে রক্ষা করিবে। করোনাকালেই আমরা শিক্ষা লাভ করিয়াছি কী প্রকারে ঘরে বসিয়াই অফিসের কার্যাদি সম্পাদন করা যায়; ভয়াবহ দুর্যোগেও জীবিকার চাকা সচল রাখিবার এই উপায় আর যাই হউক আমাদের অর্থনীতিকে পশ্চাৎমুখী হইতে দিবে না। দেশেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমরা যেইরূপ ‘উন্নতি’ হইয়াছে বলিয়া শুনিতে পাইতাম, করোনা পরিস্থিতিতে দেখা গিয়াছিল উহার বিপুল অংশ আদতে ফাঁপা। স্বাস্থ্য খাত লইয়া দুর্নীতি ও অনিয়মের কিছু ঘটনাও ঐ সময় উন্মোচিত হইয়াছিল।

আমরা বিশ্বাস করিতে চাহি, বৈশ্বিক জরুরি অবস্থার অবসান ঘটিলেও গত তিন বৎসরে স্বাস্থ্য খাত লইয়া অর্জিত শিক্ষা ও উত্থাপিত প্রশ্নসমূহ সরকার ভুলিয়া যাইবে না। বরং গৃহীত শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন ও উদ্ভাবনে কাজে আসিবে। বস্তুত বিশ্বজুড়িয়া সেই প্রবণতাই স্পষ্ট।

সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানাইয়াছে, এই দশকেই ক্যান্সারের ন্যায় মরণব্যাধির টিকা আলোর মুখ দেখিবে এবং করোনার টিকাই নাকি বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে এতটা আশাবাদী করিয়া তুলিয়াছে। এই অতিমারিকালে নাগরিকরা পরস্পরের প্রতি এবং এক দেশ অপর দেশের প্রতি যে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছে, উহাও শান্তি-সৌহার্দ্যময় বিশ্ব গড়িতে পাথেয় হইতে পারে।