পুলিশ বাহিনীর সংস্কার যেভাবে সম্ভব

ফাইল ছবি
খুরশিদ আলম ও মো. নাজমুল হক
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৯
যে কোনো দেশে পুলিশ হচ্ছে যথাযথ ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’। এর প্রধান কাজ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ও জনগণের জানমাল রক্ষা, আইন প্রয়োগ, অপরাধী গ্রেপ্তার করে আইনে সোপর্দসহ নানাবিধ দায়িত্ব পালন। বাহিনীর মতো দৃশ্যমান হলেও পুলিশ মূলত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে একজন মহাপরিদর্শক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে থেকে এ বাহিনীকে পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত হয় ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইনে। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৯৮ সালের ৫ নম্বর আইন), সাক্ষ্য আইন (১৮৭২ সালের ১ নম্বর আইন), পুলিশ প্রবিধানমালা বেঙ্গলসহ (১৯৪৩) অন্যান্য আইনে কার্য সম্পাদন করে থাকে পুলিশ। উল্লিখিত প্রতিটি আইনই ব্রিটিশ আমলের। ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থ রক্ষা ও দেশীয় মানুষকে নিয়ন্ত্রণে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা হতো এসব আইনের মাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও সহজে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল পুলিশের। প্রজাহিতৈষী না হয়ে শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করত এ বাহিনী। সেই ধারাবাহিকতায় ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উভয় রাষ্ট্রই ব্রিটিশ আইনটি নিজেদের মতো গ্রহণ করে।
নব্য উপনিবেশবাদী পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠী পুলিশকে ব্যবহারের চেষ্টা করলেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পুলিশই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় পুলিশের বাঙালি সদস্যরা। স্বাধীনতা-পরবর্তী নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সুসংহত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুলিশ। কিন্তু পরবর্তী রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় ভিন্ন পুলিশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী পুলিশকে স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করে এসেছে। ক্ষমতায় এসে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজেদের স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করেছে।
২০০৪ সালে গঠিত হয় পুলিশের এলিট ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব। এক পর্যায়ে পুলিশের মুখোমুখি অবস্থানেও চলে আসে। র্যাব জড়িয়ে পড়ে মানবাধিকারবিরোধী ‘ক্রসফায়ার’ কার্যক্রমে। এর ফলে ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্যও হারিয়ে ফেলে পুলিশ বাহিনী। আর বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার ও নিপীড়কের ভূমিকায় দেখেছে মানুষ।
বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, একই পুলিশ বাহিনীর কাজে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। মূল সমস্যা কোথায়? দ্বিমতের অবকাশ থাকলেও সমস্যাটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বর্তমান অবস্থায় পুলিশকে পূর্ণ সক্রিয়ভাবে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো।
১. কাজে ফেরানো
হাসপাতাল ডাক্তারশূন্য হয়ে গেলে যেমন সেবাগ্রহীতার সমস্যা হয়; পুলিশ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও একই রকম। তাই অনতিবিলম্বে পুলিশের মনোবল চাঙ্গা ও বাহিনীকে সুসংহত করতে কাজে যোগদান করতে না পারা সদস্যদের ফেরানো জরুরি। শুধু স্বপ্রণোদিত হয়ে অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পুলিশ সদস্যদের মতে, নিম্নপদস্থদের তুলনায় হুকুমদাতা কর্মকর্তারা গুরুতর অপরাধ করেছেন। সে ক্ষেত্রে নিম্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের আশ্বস্ত করে কাজে ফিরিয়ে হুকুমদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে সংকট নিরসনে বিগত তিন বছরে অবসরে যাওয়া উপপরিদর্শক ও পরিদর্শকদের সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য পূর্ণ বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সংকট সমাধানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই দুই বছরের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় পুলিশ নিয়োগ করতে হবে।
২. সরঞ্জাম ও সুবিধা নিশ্চিতকরণ
বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অ্যামিউনিশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করে দিতে হবে; ক্ষেত্রবিশেষ নতুন গাড়ি কিনতে হবে। অর্থ সংগ্রহে বিদেশি সংস্থার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
৩. মনোবল চাঙ্গা করা
ভয়ভীতি দূর করে মনোবল চাঙ্গা ও সুসংহত করতে ‘ফিয়ার ও প্যানিক ম্যানেজমেন্ট’ কোর্সে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশিক্ষণে মানবিক বিষয়াবলিতে গুরুত্ব দিতে হবে। মানবিক কাজে উৎসাহ প্রদানে বিভিন্ন ‘সফট স্কিল’ বিকাশের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৪. হতাহতের ক্ষতিপূরণ
যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সংঘাতে দায়িত্ব পালনকালে নিহত বা আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কনস্টেবল নিহত হলে পরিবারকে ৩০ লাখ এবং আহত হলে গুরুত্ব অনুসারে অনধিক ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। নিহত পুলিশ সদস্যের পেনশনের টাকা পরিবারের মনোনীত সদস্যদের নির্বিঘ্নে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চাকরিরত অবস্থায় মারা গেলে চাকরির অবশিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বেতনের মূল অথবা পূর্ণ বেতনের অর্ধেক পরিবারকে দিতে হবে।
৫. আর্থিক সংস্কার
অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নৈমিত্তিক ছুটি প্রদান; টিএ-ডিএ বিল প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে পরিশোধ; ঝুঁকি ভাতা প্রদান এবং অভোগ ছুটিকে নগদায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কার
সাব-ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো কমিশন গঠন করতে হবে। বিশেষভাবে কনস্টেবলদের প্রশিক্ষণের নির্দিষ্ট মান অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া যাবে না। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দুই বছরের বেশি কোনো থানায় রাখা যাবে না।
৭. পুলিশ-জনগণ সম্পর্ক
জনবান্ধব পুলিশ গড়তে প্রতিটি থানা এলাকায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি থাকতে হবে এবং নিয়মিত সমন্বয় সভা করতে হবে। জনপ্রতিনিধি ও জনগণের পক্ষ থেকে পুলিশের সঙ্গে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। দমন-পীড়ন কাজে পুলিশকে ব্যবহার করা যাবে না। অপরাধী ও নিরপরাধের সঙ্গে আচরণে ভিন্ন কৌশলের ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৮. স্বতন্ত্র পরিচালনা
পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। এটিকে সেনাবাহিনীর মতো স্বাধীনভাবে পুলিশ প্রশাসনের আওতায় চলতে দিতে হবে। পুলিশের সব পদোন্নতি, বদলি ও পদায়ন পক্ষপাতমুক্ত নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। ভর্তির সময়ে রাজনৈতিক আনুগত্যের চেয়ে যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
পুলিশের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করতে হবে। এর চেইন অব কমান্ড কঠোরভাবে অনুসরণ করে ক্ষোভ ও কষ্ট দূরীকরণে ব্যবস্থা নিতে হবে। সদস্যদের অভিযোগ লিখিতভাবে জানানো এবং বিপরীতে গৃহীত ব্যবস্থা উন্মুক্তভাবে পরিচালিত হতে হবে। পুলিশ আইনের (১৮৬১) ১৭ ধারায় বর্ণিত বিশেষ পুলিশ বিধানটি কার্যকর করতে হবে।
৯. পুলিশের অপরাধ তদন্ত
পুলিশ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও ন্যায়ানুগ কর্মকাণ্ডে বাধ্য। কিন্তু তাদের অপরাধ বাহিনীর বাইরের লোকদের দিয়ে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা দরকার। বাহিনীর নিজস্ব তদন্তকাজে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১০. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তিতে করণীয়
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট পুলিশ পরিচালনা কমিশন গঠন করতে হবে। সেখানে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি যেমন– একজন করে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, ধর্মীয় স্কলার, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি বা অতিরিক্ত আইজিপি, আদিবাসী প্রতিনিধি এবং অন্তত দু’জন নারী থাকবেন। দায়িত্বরত আইজিপি হবেন সদস্য সচিব। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত কাঠামো ও টিওআর থাকতে হবে। তারা মূলত পুলিশের কার্যক্রম মনিটর করবেন; দেখবেন ভেতর বা বাইরে থেকে বেআইনি আদেশ ও হস্তক্ষেপ হচ্ছে কিনা। অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যেমন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পুলিশের তেমন সম্পর্ক থাকতে হবে।
যুগে যুগে পুলিশকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে শাসকগোষ্ঠী। সময় এসেছে নিপীড়নের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলা বাহিনীকে জনগণের সেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী বাহিনীর উত্তরসূরিদের আবারও জনসাধারণকে আপন করে নিতে হবে; সুযোগ পেলে তারাও যাতে জনসেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে পারে।
ড. খুরশিদ আলম: সমাজ ও অপরাধবিজ্ঞানী; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট; মো. নাজমুল হক পিপিএম: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি; সহসভাপতি, বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কল্যাণ সমিতি
- বিষয় :
- পুলিশ