সুশাসন
স্বয়ংক্রিয় দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়া যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

খুরশিদ আলম
খুরশিদ আলম
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:১৩ | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:১৪
বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়টি এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছিল যে, প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা ওল্টালে শুধু দুর্নীতির কথা পাওয়া যেত, যার প্রকাশ এখনও অব্যাহত। প্রতিদিন বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা সব মধ্যবিত্তকে উৎকণ্ঠিত করে; যখন সাতটি ব্যাংক একসঙ্গে এ ধরনের লুটপাটের শিকার হয় বলে খবরে
প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশের দুর্নীতির সমস্যা নিয়ে আমি এর আগে কয়েকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছি। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাউথ এশিয়া ব্লগে এগুলো প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে মূলত দুর্নীতির কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সে সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে প্রবন্ধ লিখেছি। বাংলাদেশে এমন বিভাগও আছে, যেখানে একজন কর্মকর্তা প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা উপরি পায়। আবার কিছু সৎ কর্মকর্তাকে দেখেছি, তিনি যতদিন একটা বিভাগের প্রধান ছিলেন ততদিন সে বিভাগে কেউ তেমন দুর্নীতি করতে পারেনি।
দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানে সাফল্য তেমন আসেনি। দুর্নীতি কমানোর জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করি তা হলো:
১. দুর্নীতির পথ কমিয়ে আনা: দেশে বর্তমানে দুর্নীতি দমনের যে প্রক্রিয়া চালু আছে, তা হচ্ছে প্রথমে মানুষকে দুর্নীতি করার সুযোগ দেওয়া, তারপর তাদের ধরার চেষ্টা করা। যে কারণে দিন দিন এর পরিমাণ বাড়ছে। তাই প্রথমে দুর্নীতি করার সুযোগ কমাতে হবে। যেমন– বর্তমানে দুর্নীতির একটা বড় সুযোগ তৈরি হয় প্রকল্পের বাজেটের মাধ্যমে। প্রকল্পের বাজেট কোনো প্রকার আর্থিক বিশ্লেষণ তথা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্টের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন ছাড়া করা হয়। এতে সরাসরি ২০-৩০ শতাংশ টাকা অপচয় এবং লুট করার সুযোগ তৈরি হয়। একটি প্রকল্পে ৮-১০ কোটি টাকা যদি আপ্যায়ন ভাতা এবং বিদেশ ভ্রমণ ও থোক বরাদ্দ কয়েক কোটি টাকা নেওয়া যায় তাহলে সেখানে দুর্নীতি তো থাকবেই। এরপর থাকে অনেক কেনাকাটা, যেমন– গাড়ি বা জাহাজ কেনার জন্য অনেক বেশি
বরাদ্দ রাখা।
২. চাহিদাভিত্তিক বার্ষিক বাজেট তৈরি: বার্ষিক বাজেটে অনেক অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা হয়, যেখানে প্রচুর নয়ছয় করার সুযোগ থাকে। যেমন একটি গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে ২০ লাখ টাকা রাখা আছে কিন্তু তাতে সারাবছর দরকার হয় ৫ লাখ টাকা, নতুন গাড়ি হলে আরও কম। তাই আমরা বিআইএসআর থেকে চাহিদাভিত্তিক বাজেট তৈরির জন্য বহু বছর ধরে বলে আসছি। এই চাহিদাভিত্তিক বাজেট হলো কোন আইটেম কত পরিমাণ, কত দাম এবং মোট কত টাকা লাগবে সে অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া। এটি অনুসরণ করলে আমাদের দুর্নীতি কমপক্ষে ৬০ শতাংশ কমে যাবে।
৩. দুর্নীতিকারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) একসময় নদীর পাড় রক্ষার নামে ২০০ বোল্ডার রাতে ফেলে দুই হাজারের বিল করা হতো। কোথাও আগের করা একটি কাজকে নতুন দেখিয়ে বিল করে টাকা তুলে নেওয়া হতো। তারপর পাউবোতে নিয়ম বেঁধে দেওয়া হলো, স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মাঠে বোল্ডার বানাবে, মাঠে স্তূপ করে রাখবে। তারপর ঢাকার তিন সদস্যের মনিটরিং সেল যাবে মাঠে। তারা প্রথমে সেগুলোর মান পরীক্ষা করবে, তারপর মানুষের সামনে তা গুনবে এবং সবার সামনে দিনের বেলায় গুনে গুনে নদীতে ফেলবে। যতগুলো ফেলবে তার ১০ শতাংশের ওপরে মাঠে স্টেক করে রাখবে যেন ভবিষ্যতে কোনো ভাঙন দেখা দিলে তা প্রতিরোধের কাজে ব্যবহার করতে পারে। এভাবে অন্তত বোল্ডারসংক্রান্ত দুর্নীতি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিকাদারের কাছ থেকে বিল দেওয়ার সময় কিছু টাকা হয়তো নিতে পারে কিন্তু তা খুবই সামান্য।
৪. বিভাগীয় ইন্টেগ্রিটি ইউনিট গঠন: চোরের পিছে ছুটে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। বরং সরকারের উচিত হবে তাদের দুর্নীতি তাদের দিয়েই বন্ধ করা। প্রতিটি বিভাগে ইন্টেগ্রিটি ইউনিট গঠন করে সে বিভাগের কিছু সৎ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলে ৯০ শতাংশ দুর্নীতি কমানো সম্ভব। বড় অধিদপ্তরগুলোতে আঞ্চলিক ইন্টেগ্রিটি ইউনিট স্থাপন করতে হবে। প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মীকে প্রতিবছর অনলাইনে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে এবং তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিয়ে রিভিউ করে নিতে হবে। কোথাও কোনো দুর্নীতি হলে কেবল এই ইন্টেগ্রিটি ইউনিটকে দায়ী করা হবে। দুদকের কাজ হবে প্রতি ছয় মাস অন্তর একটি জাতীয় সার্ভে করে দেখা, দুর্নীতি কোন বিভাগে আছে আর তা কতটা? দুদকের ভূমিকা হবে শুধু তা মনিটর করা। পর্যায়ক্রমিক জরিপের (পিরিয়ডিক সার্ভে) ফল অনুযায়ী সরকার এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে যে যে কাজে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে নজরদারি আরও বাড়াতে বলা।
৫. সামাজিক প্রতিকারের ব্যবস্থা করা: প্রত্যেক শিক্ষার্থী ভর্তির আগে অভিভাবকদের সংশ্লিষ্ট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ঘোষণাপত্র হস্তান্তর করতে হবে, যাতে লেখা থাকবে সেই অভিভাবকের আয় কোনো দুর্নীতির অর্থ থেকে নয়। ব্যতিক্রম হলে সন্তানের ভর্তি বাতিল হবে।
৬. দুদকের জন্য আলাদা ক্যাডার তৈরি: সেখানে কোনো বাইরের জনবল থাকবে না। কেউ অন্য ক্যাডার থেকে আসতে পারবে না বা অন্য ক্যাডারে যেতে পারবে না। দুর্নীতি ধরার জন্য তাদের প্রণোদনা (ইনসেনটিভ) দিতে হবে। দুদককে আলাদা স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলতে দিতে হবে। তাদের পরিচালককে সচিব পদমর্যাদা দিতে হবে। আর ডিজিকে জ্যেষ্ঠ সচিব করতে হবে। দুদক আইন বদল করতে হবে, যেমন এক কোটি টাকার দুর্নীতি করলে ফাঁসি, ৫০ লাখ করলে যাবজ্জীবন এবং তার কম করলে ১০ বছরের জেল হবে। দুর্নীতি হচ্ছে কিনা, তা প্রতিটি বিভাগের যে কোনো পিয়নকে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারে। তার জন্য বিশাল বাহিনীর দরকার হয় না।
মোদ্দাকথা, বাংলাদেশে দুর্নীতি দূর করতে হলে বর্তমান দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। এটি অনেকটা বিনা খরচে করা সম্ভব। এটি অনুশীলন করলে তিন মাসের মধ্যে ৯০ শতাংশ দুর্নীতি কমানো যাবে।
ড. খুরশিদ আলম: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট
Email: khurshedbisr@gmail.com
- বিষয় :
- সুশাসন