বাড়ছে কার্ডে লেনদেন
.
ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:৫২ | আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১০:৫৭
একটি সময় ব্যাংক মানেই যেন ছিল লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা, উত্তোলন, পে-অর্ডার নগদায়ন। সময়ের সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনে সেবার ধরন বদলেছে। এখন আর আগের সেই দিন নেই। কার্ড কিংবা অ্যাপ ব্যবহার করে কেনাকাটার বিল, বিভিন্ন ইউটিলি বিলসহ নিজ থেকে বিভিন্ন পরিশোধ করা যাচ্ছে। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর করা যাচ্ছে এক ক্লিকে। এতে নগদ বহনের ঝামেলা কমেছে। আবার জাল নোট, পকেটমারের ঝুঁকিও কমেছে। কার্ড লেনদেনে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলো ছাড়সহ নানা অফার দিচ্ছে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে কেনাকাটার বিল পরিশোধে মিলছে ছাড়। অনেক ব্যাংকের কার্ডের ধরন ভেদে ফ্রিতে বিভিন্ন বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ তো আছেই।
ব্যাংকাররা জানান, করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে অতিমারির ওই সময়ে ঘরবন্দি জীবনের কারণে কার্ড বা অ্যাপের মতো অনলাইন লেনদেনে আগ্রহ বাড়ে। করোনার সময় লকডাউন ও আতঙ্কের কারণে অনেকেই তখন ঘরবন্দি ছিল। এর পর কার্ডের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। ২০২০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত চার বছরে কার্ডের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। আবার অ্যাপ, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, অনলাইন-ভিত্তিক নানা লেনদেনেও আগ্রহ বেড়েছে ব্যাপক। গ্রাহক চাহিদা বিবেচনায় আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত এ ধরনের সেবার প্রসার হয়েছে। ব্যাংকগুলো এ খাতে অনেক বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৬ হাজার। গত বছরের জানুয়ারি শেষে মোট কার্ড ছিল ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার। এর মানে এক বছরে বেড়েছে ৭০ লাখ ৩৮ হাজার বা প্রায় ২০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট কার্ডের বেশির ভাগই ডেবিট তথা নিজের অ্যাকাউন্টের বিপরীতে লেনদেনের জন্য। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ডেবিট কার্ড দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫২ লাখ। গত বছরের একই মাসে যা ছিল ৩ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার। ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা গত বছরের জানুয়ারির ২১ লাখ ৫৯ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার। ডেবিটের তুলনায় ক্রেডিট কার্ড বেড়েছে কম। আর প্রি-পেইড কার্ডের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৩ লাখ ১ হাজার। ২০২৩ সালের জানুয়ারি শেষে যা ছিল ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার।
করোনার আগের বছর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সব ব্যাংক মিলে ইস্যু করা মোট কার্ড ছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ ২১ হাজার। এর মধ্যে ডেবিট কার্ড ছিল ১ কোটি ৫২ লাখ ৪৪ হাজার। ক্রেডিট কার্ড ছিল ১৩ লাখ ১৩ হাজার। আর প্রি-পেইড কার্ড ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার। এর পরের বছর ২০২০ সালে কার্ডের সংখ্যা বেড়ে হয় ২ কোটি ৫ লাখ ৬৫ হাজার। ২০২১ সালের জানুয়ারি শেষে তা ২ কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে মোট কার্ড দাঁড়ায় ২ কোটি ৮৬ লাখ ২১ হাজার। শুধু কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে তেমন নয়, লেনদেনও বাড়ছে দ্রুত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, খরচ, সময় ও ঝুঁকি বিবেচনায় এখন অনলাইনভিত্তিক লেনদেনই সব চেয়ে নিরাপদ। যে কারণে কার্ড, অ্যাপসহ অনলাইন লেনদেন বাড়াতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকেও বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে সহজে লেনদেন, সব পর্যায়ে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম করে দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের দিক থেকেও এখন ভালো সাড়া মিলছে। যে কারণে দ্রুত এ ধরনের লেনদেন বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ডেবিট কার্ড থেকে লেনেদেন হয়েছে মোট ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে মোট ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। এর মানে এক বছরে লেনদেন বেড়েছে ৯৯ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বেড়েছিল অবশ্য ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ডে ২০২৩ সালে মোট ৩১ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এক বছর আগে ২০২২ সালে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এর মানে গত বছর লেনদেন বেশি হয়েছে ২ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২০২১ সালে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনর পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। এর মানে লেনদেন বেশি হয়েছিল ৭ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ ছাড়া প্রিপেইড কার্ডে ২০২৩ সালে ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের বছর লেনদেনর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৯২ কোটি টাকা।
গ্রাহকরা এখন এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে পরিশোধ করতে পারেন। এক ব্যাংকের এটিএম বুথ ব্যবহার করে আরেক ব্যাংকে পরিশোধ করা যায়। যে কারণে সবচেয়ে বেশি এটিএম বুথ থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ডেবিট কার্ডে এগিয়ে আছে। ঢাকাসহ সারাদেশে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথ রয়েছে ৪ হাজার ৯০৭টি। ডেবিট কার্ডে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। এর পর পর্যায়ক্রমে ব্যাংক এশিয়া, সিটি, সোনালী, ইউসিবিএল, ব্র্যাক, যমুনা, ট্রাস্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট রয়েছে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায়। আর সবচেয়ে বেশি ক্রেডিট কার্ড রয়েছে বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি খাতের অন্যতম ব্র্যাক ব্যাংক। এর পর পর্যায়ক্রমে প্রাইম, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ইউসিবিএল, ইস্টার্ন, ডাচ্-বাংলা, ন্যাশনাল, সাউথইস্ট ও ব্যাংক এশিয়া রয়েছে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায়।
ব্যাংকাররা জানান, ইফতার কিংবা ঈদের কেনাকাটায় কার্ডে পরিশোধ করলে আকর্ষণীয় ছাড় কিংবা ক্যাশব্যাক অফার দিচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক। উৎসবের আগে ডেবিট বা ক্রেডিটু উভয় কার্ডেই কেনাকাটায় উৎসাহিত করতে এরকম নানা অফার নিয়ে হাজির হয় বিভিন্ন ব্যাংক। নিজেদের প্রচারণার অংশ হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে লোকসান করে এসব অফার দেয় ব্যাংক। নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি বিবেচনায় গ্রাহকদের অনেকে কার্ডে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আবার শাখায় গিয়ে লাইন ধরে লেনদেন করতে বাড়তি সময় লাগে। এ ছাড়া ব্যাংকিং সময়ের বাইরে যে কোনো লেনেদেনের সুবিধার কারণে এখন কার্ড লেনদেনে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
কার্ডে কেনাকাটায় মিলছে নানা ছাড়
ব্র্যাক ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সেহরি ও ইফতারি কেনা ছাড়াও জুয়েলারি, হোম অ্যাপ্লায়েন্স কেনাকাটায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট। রমজান মাসে ইস্টার্ন ব্যাংকের স্কাইব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহার করে বেশি বেশি লেনদেন করে টিভি, ফ্রিজ, এসিসহ আকর্ষণীয় নানা পুরস্কার মিলছে। সিটি ব্যাংকের কার্ড থেকে ঈদের পোশাক, জুতা, জুয়েলারিসহ নির্দিষ্ট শোরুম ও পণ্য কেনাকাটায় ব্যাংকটি দিচ্ছে ১০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়। পাশাপাশি ইফতারে মূল্য ছাড়ের সঙ্গে রয়েছে একটি কিনলে একটি ফ্রিসহ বিভিন্ন ‘ঈদ অফার’। ব্যাংকটির আমেরিকান এক্সপ্রেস প্লাটিনাম ক্রেডিট কার্ডে ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতে প্রতি মাসের শুক্র ও শনিবার আকর্ষণীয় অফার তো আছেই। এপ্রিল মাসে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা ‘এলিমেন্টস-গ্লোবাল ডাইনিং’ একটি কিনলে দুটি ফ্রি বুফে পাবেন গ্রাহক।
রেস্তোরাঁ, লাইফস্টাইল, জুয়েলারি ও মেকওভার, ই-কমার্সসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডে ইস্টার্ন ব্যাংকের গ্রাহকেরা কার্ডে পাচ্ছেন ৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে কেনাকাটায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার রয়েছে। প্রাইম ব্যাংকের কার্ড থেকে কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ডে আসবাব, ভ্রমণ, খাবার, লাইফস্টাইলসহ বিভিন্ন খাতে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় মিলছে। ক্যাশব্যাক, পয়েন্ট অর্জন, ছাড়সহ বিভিন্ন অফার এনেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। এ ছাড়া বুফে ইফতার ও সেহেরিতেও অফার রয়েছে তাদের কার্ড থেকে কেনাকাটায়। লাইফস্টাইল, গ্রোসারি, ডাইনিং, অনলাইন শপ, ভ্রমণসহ বিভিন্ন খাতের ব্র্যান্ডে ঢাকা ব্যাংকের কার্ডে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যাচ্ছে। লাইফস্টাইল ও মুদিদোকানের কেনাকাটায় যমুনা ব্যাংক দিচ্ছে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার। প্রিমিয়ার ব্যাংক ব্র্যান্ড ও পণ্যে, খাবার এবং ভ্রমণে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় কার্ডে ছাড় দিচ্ছে। মিডল্যান্ড ব্যাংকেও কেনাকাটায় থাকছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়। ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লংকাবাংলার েক্রেডিট কার্ডে ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ছাড় উপভোগ করছেন গ্রাহকরা।
ক্রেডিট কার্ডে কোথায় বেশি খরচ হয়
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে গ্রাহকরা দেশ ও দেশের বাইরে কোথায় কেমন খরচ করেন, সে বিষয়ে জানুয়ারি পর্যন্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারিতে দেশের ভেতরে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা খরচ করেছেন গ্রাহক। এর মধ্যে ৩৯ দশমিক ৩১ শতাংশ হয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কেনাকাটার বিল পরিশোধে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খুচরা দোকানে, ১৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। পর্যায়ক্রমে ইউটিলিটি বিল, নগদ উত্তোলন, পোশাক কেনা, ওষুধ, অর্থ স্থানান্তর, পরিবহন, ব্যবসায়িক সেবা, পেশাগত সেবা। আর সবচেয়ে কম শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ খরচ হয়েছে সরকারি সেবার পেছনে।
ডলার সংকটের কারণে বিদেশে লেনদেনে বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যেই ক্রেডিট কার্ড থেকে গত জানুয়ারিতে দেশের বাইরে ৫৩২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আগের মাসে খরচের পরিমাণ ছিল ৫৭৯ কোটি টাকা। দেশের বাইরেও খরচের খাতে এক নম্বরে রয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে খরচের পরিমাণ ছিল ১৪৬ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এ ছাড়া খুচরা আউটলেটে খরচ হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ওষুধে গেছে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, নগদ উত্তোলনে ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ, পোশাকে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, পরিবহনে ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ, ব্যবসায়িক সেবায় ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ, সরকারি সেবায় ৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ, পেশাদারি সেবায় ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং ইউটিলিটি বিল পরিশোধে ২ দশমিক ৪০৯ শতাংশ।
- বিষয় :
- লেনদেন
- ডিজিটাল লেনদেন
- ডেবিট কার্ড
- ক্রেডিট কার্ড