আগামী
বর্তমান ভবিষ্যৎ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ২২:৩৭
যে দেশের বয়স একান্ন পেরিয়ে গেছে, তার আগামী নিয়ে ভাবতে বসলে সেই ভাবনায় অতীতটা অবধারিতভাবেই জায়গা করে নেয়। একটা সার্বক্ষণিক তুলনা-সূত্র হিসেবে সক্রিয় থাকে। বর্তমানটাও এই ভাবনায় অনিবার্যভাবে আসে, যেহেতু বর্তমান সেই পাটাতন, যা অতীত তৈরি করে দেয়, এবং যা ভবিষ্যতে উত্তরণের সম্ভাবনা তৈরি করে।
আমার লেখার বিষয় মুক্তচিন্তার ভবিষ্যৎ, অর্থাৎ আগামীতে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা গুরুত্ব, চর্চা, প্রভাব, সত্যবাদিতা ও সাহস নিয়ে আমাদের প্রতিটি ডিসকোর্সে সক্রিয় থাকবে, সেই নিসর্গচিত্রটি আঁকা। তবে তা করতে গিয়ে বিপরীত চিত্রটিকেও অর্থাৎ আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, বিচারিক, নৈতিক, মিডিয়াভিত্তিক এবং অন্যান্য ডিসকোর্সে মুক্তচিন্তা যে অনুপস্থিত থেকে যেতে পারে; বিরুদ্ধ পরিবেশ, অপশাসন ও দুর্নীতি এবং নানা আইনি বাধাবন্ধকতা এবং ভয়-ভীতির দেয়ালে বন্দি হয়ে যেতে পারে; সেই আশঙ্কাকেও খতিয়ে দেখা। আমি জানি, আমাদের মুক্তচিন্তার বর্তমানটা আশাব্যঞ্জক নয়। তবে আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই- সেই ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত; তাহলে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। যেহেতু সেই দুঃসহ অতীতে আমরা মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হারিয়ে যেতে দিইনি; এর প্রকাশকে বরং যতটা সম্ভব বলিষ্ঠ করেছি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে কেন জানি আমরা সামষ্টিকভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সেই শক্তিটি হারিয়েছি, যা নব্য ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনের চব্বিশটি বছর আমাদের উদ্দীপ্ত রেখেছিল; যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমরা পাকিস্তানিদের সামরিক শাসনের কোনো বিধানকে ভয় করিনি। তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যটা বলে গেছি। কিন্তু নিজের দেশে যখন অধিকার হারাতে থাকলাম; সামরিক-আধাসামরিক শাসনের নানা প্রতিবন্ধকতাকে নিয়তি বলে মেনে নিলাম; একই সঙ্গে মুক্তচিন্তার পরিসরকে সংকুচিত হতে দেখলাম, তেমন কোনো প্রতিরোধ আমরা তৈরি করতে পারলাম না; প্রতিবাদটা যদিও সবসময় ছিল।
আমি মনে করি, এটি হয়েছে একটি প্রধান কারণে। একাত্তরে যে ঐক্য আমাদের একটা অভিন্ন ভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল; যে পরাক্রম আমাদের ভেতর তৈরি করেছিল; সেই ঐক্যটিই স্বাধীনতার পর আর থাকেনি। সেই ঐক্যে যারা ফাটল ধরাল; যারা একাত্তরজুড়েই স্বজাতির বিরুদ্ধে কখনও মতবাদগত, কখনও সশস্ত্র যুদ্ধে নেমেছিল; তারা একাত্তরের পর সক্রিয় হলো; পঁচাত্তরের পর রাজনীতির মাঠে নামল, এবং এতদিনে বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে তারা আগামীর বাংলাদেশকে করায়ত্ত করার জন্য রীতিমতো প্রস্তুত। আমাদের দুই বড় বর্গে বিভক্ত রাজনীতির একটি বর্গ, দুঃখজনকভাবে এই শক্তির প্রভাবে একাত্তরকে অস্বীকার করে। একে মনগড়া এক বয়ানে ফেলে নিজেদের করে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শচিন্তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে গেছে। আজ যে শক্তি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শচিন্তাকে তাদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার উৎস হিসেবে দাবি করে, তারা আছে অন্য বর্গে; যদিও তারাও সেই আদর্শ থেকে যতটা দূরে যাওয়া যায়, গেছে। ফলে পুঁজি এবং পণ্যবাজার সহজেই আমাদের রাজনীতি, মিডিয়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্র তার আধিপত্য কায়েম করেছে। আমাদের অর্থনীতি এখন পুঁজির শাসনে এমন সব বাজারবান্ধব পথের সন্ধানে যাচ্ছে, যার একদিকে আছে চকচকে উন্নয়ন, অন্যদিকে আছে বৈষম্য, দুর্নীতি এবং নৈতিক অবক্ষয়। যে দেশ থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়; চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি থেকে নিয়ে নির্মাণসামগ্রী কেনায় পুকুরচুরি হয়; শিশুখাদ্য ও পথ্যে নির্দি্বধায় ভেজাল মেশানো হয়, সে দেশে মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধ শক্তির অভাব থাকে না। পুঁজির শাসন একদিকে মুক্তচিন্তার পক্ষে আওয়াজ তোলে; পুঁজির অর্থায়নে অনেক এনজিও এবং অধিকার গ্রুপ মুক্তচিন্তার পক্ষে মাঠে নামে, কিন্তু দিনের শেষে মুক্তচিন্তাকে বোতলবন্দি করে রাখতে সব পদক্ষেপই নেওয়া হয়, যেহেতু সত্যিকার অর্থে মুক্তচিন্তা জাগ্রত থাকলে বৈষম্য, দুর্নীতি, পুকুরচুরি এসব নিয়ে প্রত্যেক মানুষ প্রশ্ন তোলে।
আমার বিস্ময় জাগে, যখন দেখি একাত্তরে যে দলটি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও এর সফল সমাপ্তিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, সেই দলটি এখন মুক্তচিন্তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। এর পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (সংক্ষেপে ৫৭ ধারা) এখনও অটুট আছে, যদিও এর বিরুদ্ধে জনমত প্রবল। আমার আরও বিস্ময় জাগে, যখন দেখতে পাই সরকারবিরোধী প্রধান দলটি তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের দিকে না তাকিয়ে, নিজেদের আমলনামাকে ভুলে গিয়ে মুক্তচিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে মাঠ কাঁপায়। এদের সমর্থক যেসব বুদ্ধিজীবী এখন মুক্তচিন্তার পক্ষে টেলিভিশনের টকশোকে মুখর করে রাখেন; সরকার বদল হলে তাঁরাই এমন এক রক্ষণশীল অবস্থানে চলে যাবেন, যে ৫৭ ধারার চেয়ে কঠিন কিছু ধারা সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করলেও তাঁরা এর পক্ষেই বরং নানা যুক্তি তুলে ধরবেন। দু'এক ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু তার প্রভাব সামান্যই।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- তাহলে ভবিষ্যতে কীভাবে মুক্তচিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী ও বাধাহীন করা যাবে।
২. এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের একটা প্রয়োজনীয় যোগসূত্রের উল্লেখ করা যায়। প্রচলিত প্রজ্ঞা অনুযায়ী, অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যৎমুখী সময় প্রবাহটি বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের সংস্কৃতি, জীবনাচরণ; তাদের জাগতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মানবিক উন্নতি সাধন করে, সুস্থতা নিয়ে তাদের বেঁচে থাকার উপায়গুলো সহজসাধ্য করে। সকল ক্ষেত্রে যে তা হয়, তা নয়। তবে মোটাদাগে এভাবেই যুগের এবং মানবসমাজের এগিয়ে যাওয়া। এ জন্য মানুষ চেষ্টা করে অতীত থেকে বর্তমানটা ভালো করতে। এবং এটি নিশ্চিত করার চেষ্টা কৃষি থেকে নিয়ে রাজনীতি- সর্বত্র মানুষকে নিয়োজিত এবং আশান্বিত করে। আমাদের কৃষক এই আশা নিয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়ান; মানুষকে দু'বেলা আহার জোগান। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে, দুঃখজনকভাবে সামনে এগোনোর বিষয়টা নেই; উন্নতির চিন্তাটাও নেই। যেহেতু সেটি করতে গেলে নিঃস্বার্থ হতে হয়; মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হয়। রাজনীতি এখন ব্যবসার জিনিস। এর বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ীরা। রাজনীতি বরং অতীত থেকে ভালো হওয়ার পরিবর্তে মন্দ হচ্ছে। আমাদের বর্তমানের ছাত্র রাজনীতির দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
অতীত নিয়ে আরেকটি কথা বলা যায়। রাজনীতিবিদরা অতীত ভুলিয়ে দিতে চান, যেহেতু অতীতের ভালো চর্চাগুলো মানুষকে বর্তমানের জন্য অনুপ্রাণিত করে। এই অনুপ্রেরণা রাজনীতিবিদদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। তারা ভালো চর্চা করলে; তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিকতা এবং ঔচিত্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে; তারা প্রকৃতপক্ষে গণমুখী হয়ে গেলে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমে পড়বে। রাজনীতি তখন আর বাজারবান্ধব থাকবে না। বাজার যেহেতু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে; বাজারই তখন এই পরিবর্তনের বিপক্ষে যায়। রাজনীতি আর সামনে এগোয় না। সে জন্য চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা যেমন বলেন- ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।
কথাটার অর্থ এই :ক্ষমতা মানুষকে অতীতের অর্জনগুলোকে ভুলিয়ে দিতে চায়; তার অধিকার, পরিচিতি, সাংস্কৃতিক একক-বিশিষ্টতা, ইতিহাস- সবকিছু অস্পষ্ট করে, মুছে ফেলে। তাকে বর্তমানে স্থিত করে এবং বর্তমানকেই শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নিতে বাধ্য করতে চায়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আজ একান্ন বছর পর কি সেই মুক্তিযুদ্ধ আছে? এর এখন কত ভ্রান্ত পাঠ, অসত্য বয়ান! মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ একান্ন বছরে বিস্মৃতির ঘরে ঢুকে গেছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে তাহলে আমরা কীভাবে লড়াই করি? কারা সেই লড়াই করবে? মিডিয়ায় আছে সরকার ও নানা মতের অনুসারী মহলের নিয়ন্ত্রণ। মিডিয়ার মালিকরা বাজারবান্ধব। তাঁরা বাজারের সূত্র মেনে চলবেন। নাগরিক সমাজ দলে দলে বিভক্ত। সেই দলগুলো তাদের মাতা-দলের আওয়াজই গলায় তুলবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাম-ডান-উগ্র ডান, হিংসা-অসূয়াবাদী নানা তর্কে আকীর্ণ। এই মাধ্যমে ইমেজ বা ছবি দখল করে রাখে মানুষের মনোজগৎ। সেখানে আত্মতুষ্টি, প্রদর্শন মনোবৃত্তি এবং লোভের সংস্কৃতির চর্চা হয়। ফলে সৃজনশীল, সমাজ ও গণমুখী যাঁরা এই মাধ্যমে সক্রিয়, তাঁরা তলানিতে পড়ে থাকেন।
আমার ভরসা তরুণদের ওপর, যেহেতু একজন শিক্ষক হিসেবে প্রতিদিন আমি তাদের সান্নিধ্যে আসি। কিন্তু তরুণদের একটি বড় অংশই নানা মতবাদে প্রভাবিত। রাস্তায় এখন যত মিছিল হয়, তার সবই বড় দুটি দলের পক্ষে-বিপক্ষে। এসব মিছিলে যারা যায়, তারা মুক্তচিন্তা বলতে তাদের দলের পক্ষে প্রচারের স্বাধীনতাকেই বোঝে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে যে মুক্তচিন্তার বাধাহীন চর্চা হবে- তা ভাবার কোনো কারণ নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হবে- এটা ভেবে রোমাঞ্চিত হওয়ারও প্রয়োজন নেই। কালাকানুন বরং আরও বাড়বে। মুক্তচিন্তার পক্ষে অবশ্য সুন্দর সুন্দর কথা শোনা যাবে; আমরা যেহেতু আমাদের কাজের অক্ষমতাকে কথা দিয়ে ঢাকতে খুবই পারদর্শী।
৩. তবে লেখাটি যেহেতু মুক্তচিন্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে, এবং আমি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী; দু'চার দশক সামনে তাহলে তাকানো যাক। মুক্তচিন্তার বাধাহীন চর্চার একটা ছবি তখন আমাদের চোখে পড়বে। এই ছবিটা বাস্তব হওয়ার পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। তার কিছু তুলে ধরা যাক।
প্রথমত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলে যার কথা আমরা শুনে আসছি, যার চালিকা শক্তি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্টেট অব দি আর্ট- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং উন্নত যোগাযোগ; তা রাজনীতিকে গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক হতে বাধ্য করবে। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও ক্যাশলেস সমাজে পরিণত হবে। অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে নগদ বিনিময় উঠে গিয়ে ব্যাংকের দেওয়া নানা কার্ডের মাধ্যমে তা হবে। এ ধরনের যে কোনো বিনিময় একটা ডিজিটাল পদচ্ছাপ রেখে যায়, যা একটি স্কুলের বাচ্চাও অনুসরণ করে যে কোনো অবৈধ লেনদেনের হদিস পাবে। নগদ টাকায় বড় অঙ্কের বিনিময় অসম্ভব হলে দুর্নীতিচিত্রে এর প্রভাব পড়বে। বছর কুড়ি আগে এক বিদেশি জার্নালে পড়েছিলাম, প্রযুক্তি মানুষকে সৎ হতে বাধ্য করবে। এক রাস্তা দূরের কোনো বাড়িতে বসে কেউ কারও নিন্দা করলে বা কোনো ষড়যন্ত্র করলে তা যে কেউ জেনে যাবে, যদি তার কাছে আড়িপাতার যন্ত্রগুলো থাকে। সেগুলো হবে অতি ক্ষুদ্র এবং সস্তা। ওই লেখার ভেতর কিছুটা কৌতুক ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে আমরা এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার নানা জায়গায় দেখছি। জার্নালটি আরও লিখেছিল, পুলিশ যদি কাউকে অকারণে আটকে রেখে নির্যাতন করে, সেই চিত্র সরাসরি বাইরের কোনো বড় বিজ্ঞাপনের পর্দায় মানুষ দেখতে পাবে, যদি যাকে নির্যাতন করা হচ্ছে তিনি বুদ্ধি করে অতি উন্নত প্রযুক্তির অতি ক্ষুদ্র একটি চিত্রগ্রাহক ডিভাইস জায়গামতো রেখে দিতে পারেন, যার হদিস পুলিশের স্ক্যানারেও ধরা পড়বে না।
সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যদি উন্নত বিশ্বের কাতারে দাঁড়াতে চাই; আমাদের রাজনীতি থেকে নিয়ে সর্বত্র প্রচুর স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে জবাবদিহির চর্চা, যা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে মুক্তচিন্তা।
দ্বিতীয়ত, রাজনীতির বর্তমান চর্চা বদলাতে হবে। ছাত্র রাজনীতি হয় পরিত্যাজ্য হবে, না হয় গণমুখী ও আদর্শিক অবস্থানে তা যাবে। যেহেতু প্রযুক্তি প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতাকে ২৪/৭ মানুষের নজরে নিয়ে আসবে; তাদের বদলাতেই হবে। তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায়, তারা আর কল্ক্কে পাবে না। প্রযুক্তির সহায়তায় সত্য খুঁজে পেলে কেন মানুষ অসত্য বেছে নেবে? বিশ্বের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কেন মানুষ মান্ধাতার আমলের রাজনীতি আর প্রশাসন মেনে নেবে? আর প্রযুক্তি যদি ভোটাভুটিকে স্বচ্ছ হতে বাধ্য করে; প্রকৃত গণতন্ত্র নির্বিকল্প হয়ে দাঁড়াবে। প্রকৃত গণতন্ত্র মুক্তচিন্তাকে বাধাহীন করবে।
তৃতীয়ত, মুক্তচিন্তার চর্চা ঘটে যেখানে; পরিবার থেকে নিয়ে প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়াতে; সেগুলোও বদলে যাবে। শতভাগ শিক্ষিতের দেশ বাংলাদেশে মিডিয়াতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। দৃশ্যমাধ্যমের শাসন এখন যে রকম গ্রহণযোগ্য; দু'চার দশক পর তখন সে রকম থাকবে না। এখন যাদের সিটিজেন জার্নালিস্ট বলা হয়, অর্থাৎ যে নাগরিক একটি মোবাইল ফোনে কোনো ঘটনার চিত্র ধারণ করে সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে পৌঁছার অনেক আগেই যোগাযোগমাধ্যমে তা ছেড়ে দিতে পারেন; তাঁদের সংখ্যা বাড়বে। দেখা যাবে, সকল ব্রেকিং নিউজ এরাই তৈরি করছেন। ব্লগে তাঁরা মতামত দিচ্ছেন। সংবাদ বিশ্নেষণ করছেন। সত্য প্রকাশে এদের কেউ কেউ নিজস্ব মতের অনুসারী হলেও এদের ছাপিয়ে নির্ভীকভাবে সত্য প্রচারকারীদের অবস্থান সুদৃঢ় থাকবে। পত্রপত্রিকার সিংহভাগ অনলাইনে আশ্রয় নেবে; তাদেরও টিকে থাকার জন্য সত্যকে সামনে আনতে হবে। যে ব্যাপক আকার এই সংবাদ সরবরাহ ধারণ করবে, তাকে আইনের ফাঁক-ফোকরে নিয়ে আসতে বা তার প্রচার সীমিত করতে কোনো সরকারি পদক্ষেপই সফল হবে না। প্রযুক্তি সরকারগুলোকেও সৎ হতে বাধ্য করবে।
চতুর্থত, শিক্ষার অভিঘাতে মানুষের মননে পরিবর্তন আসবে। শিক্ষার সংস্কৃতি, যা মানুষকে সকল অর্থেই আলোকিত করে- এক প্যারাডাইম শিফট তৈরি করবে; যা মানুষকে মিথ্যা, অসত্য প্রচারণা, নানান অপচর্চা এবং বাধানিষেধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করবে। এটি পৃথিবীর অনেক দেশের আগেই বাংলাদেশে ঘটবে।
বাংলাদেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে; আর দু'চার দশক পর সেই জায়গাটাকে অনেক পেছনে ফেলে বিশ্বের মহাসড়কে বিপুল বেগে সামনে এগোবে। এটি কোনো অলীক স্বপ্ন নয়। বর্তমানকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বরং তা একটি বাস্তব চিত্র হয়ে দাঁড়ায়। সেই ভবিষ্যৎটা খুব দূরে নয়।
লেখক
কথাসাহিত্যিক