ঢাকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

খাদ্য বিভাগের ‘গুপ্ত খাদক’ শহিদুল

ধান-চাল ব্যবসার নামে কোটি টাকার প্রতারণা

খাদ্য বিভাগের ‘গুপ্ত  খাদক’ শহিদুল

শহিদুল ইসলাম।

মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২৪ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৯:২৪

গাইবান্ধার খাদ্য বিভাগের হিসাবরক্ষক শহিদুল ইসলাম ঘিরে বেরিয়ে আসছে নানা প্রতারণার তথ্য। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভনে ধান-চালের ব্যবসার নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংক চেক এবং স্ট্যাম্প ব্যবহার করে দীর্ঘদিন চালিয়েছেন এই প্রতারণা। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসে। এরই মধ্যে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাঁকে।

খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে গাইবান্ধা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি পান গাইবান্ধা সদরের খামার পীরগাছা গ্রামের শহিদুল ইসলাম। এর পর অডিটর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে লালমনিরহাট, পরে গাইবান্ধায় যোগ দেন। ২০২২ সালে শহিদুল আরেক দফা পদোন্নতি পেয়ে হিসাবরক্ষক হন। এর পর তিনি বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে যোগ দেন। যদিও তাঁর মূল কর্মস্থল মৌলভীবাজারে কাজ না করে তদবিরের মাধ্যমে  উত্তরাঞ্চলের ধান-চালে উদ্বৃত্ত জেলাগুলোতে পদায়ন নেন। 

জানা গেছে, শহিদুল প্রতারণা করতেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। ধান-চাল ব্যবসায় বিনিয়োগে আকর্ষণীয় লাভের প্রলোভনে সাধারণ ব্যবসায়ী কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করতেন। বিনিময়ে লিখিত চুক্তি এবং ব্যাংক চেক দিতেন। সেসব চেকে ইচ্ছা করে ত্রুটি রাখার পাশাপাশি অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় সেগুলো ডিজঅনার হতো।

ভুক্তভোগীর একজন গাইবান্ধার নীলা বেগম জানান, বিনিয়োগের নামে শহিদুল তাঁর কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা নেন। প্রতি মাসে লাভসহ মূলধন ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর পর গত বছরের ২০ জানুয়ারি জনতা ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে শহিদুলকে টাকা দেন। টাকা দেওয়ার ৫ মাস পর ২২ মে শহিদুল তাঁর জনতা ব্যাংকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের একটি চেক দেন। পরে টাকা উঠাতে গেলে জানতে পারেন, অ্যাকাউন্টে কোনে টাকা নেই। বাধ্য হয়ে একই বছরের ৬ আগস্ট চেক ডিজঅনারের মামলা করেন তিনি।

আরেক ভুক্তভোগী কামরুল হাসান বলেন, ভালো সম্পর্কের কারণে ২০২১ সালের ২১ আগস্ট ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামার মাধ্যমে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিই। দীর্ঘদিন ঘুরানোর পর ২০২৩ সালের ২১ মে আমাকে তাঁর নিজের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের তিন লাখ টাকার একটি এবং সাড়ে তিন লাখ টাকার জনতা ব্যাংকের একটি চেক দেন। পরে টাকা তুলতে গেলে চেক ডিজঅনার করে দেয় ব্যাংক। এর পর মামলা করলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। 

শুধু নীলা বা কামরুল নন; গাইবান্ধা শহরের রাশেদ ইসলাম, বিপু মিয়াসহ অনেকেই শহিদুলের প্রতারণার শিকার। কেউ ধান-চালের ব্যবসার লাভের আশা, কেউ খাদ্য গুদামে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার লোভ, আবার কেউ বন্ধুত্বের খাতিরে তাঁকে টাকা দিয়েছেন।

রাশেদ ইসলাম জানান, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় সে আমার সঙ্গে লেনদেন করত। সেই হিসেবে আমিও টাকা দিয়েছি। সে যে এভাবে টাকা মেরে দেওয়ার চিন্তা করবে, ভাবিনি! আমাকে ইসলামী ব্যাংকের ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি চেক দিয়েছিল। সেই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছি। সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। সামনের তারিখে রায়ের অপেক্ষা করছি। 

ব্যবসায়ী বিপু মিয়া বলেন, শহিদুলের প্রতারণার শিকার হয়ে আমি বগুড়া খাদ্য অফিসে একাধিকবার গিয়েছি। সে আমাকে খাদ্য গুদামে ধান-চাল লোডের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। গুদামে মাল পৌঁছে দিলে প্রতি লোডে ২০ হাজার টাকা লাভের কথাও বলেছিল। ২০২১ সালে কয়েক দিনের জন্য ৫ লাখ টাকা ধার নেয়। অনেক ঘোরাঘুরির পর ৩ লাখ টাকা দিলেও এখন পর্যন্ত ২ লাখ টাকা দেয়নি। 

প্রতারণার ক্ষেত্রে শহিদুল সুনির্দিষ্ট কৌশল নিতেন। প্রাথমিকভাবে কিছু মানুষকে তাদের টাকা ফেরত দিয়ে আস্থা অর্জন করতেন, তারপর বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়া, লালমনিহাট ও নওগাঁর কয়েক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকেও খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে শহিদুল কোটি টাকার ওপরে নিয়েছেন। এদের প্রত্যেকের কাছেই টাকা নেওয়ার প্রমাণপত্র হিসেবে স্ট্যাম্পে চুক্তিনামা ও ব্যাংকের চেক রয়েছে।

গত ২৮ নভেম্বর শহিদুলকে বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে গাইবান্ধায় তিনটি চেক ডিজঅনার মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। যদিও একদিন কারাগারে থাকার পরই নিজের প্রভাব বিস্তার করে জামিনে মুক্ত হন শহিদুল। 
অভিযুক্ত শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। উল্টো আমিই তাদের কাছে টাকা পাই। যারা আমার কাছে টাকা পেত, জমি বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করেছি।’ 

গাইবান্ধা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান জানান, ২০২২ সাল থেকে শহিদুল ইসলাম অডিটর হিসেবে এখানে কর্মরত ছিলেন। শুনেছি, তাঁর কাছে এলাকার অনেকেই টাকা পান। বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জেনেছি। তাঁর ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। 

বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রিয়াজুর রহমান রাজু বলেন, তাঁর মূল কর্মস্থল ছিল মৌলভীবাজার। বগুড়া জেলা অফিসে তিনি সংযুক্ত ছিলেন। এ ঘটনার পর তাঁকে মৌলভীবাজারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। গ্রেপ্তারের কারণে তাঁকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে তাঁকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করবে খাদ্য বিভাগ।

গাইবান্ধা সদর থানার ওসি শাহিনুর তালুকদার বলেন, শহিদুলকে গত ২৮ নভেম্বর বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের তিনটি মামলার পরোয়ানা ছিল। আদালতে সোপর্দ করার পর তাঁর জামিন হয়েছে।

আরও পড়ুন

×