অবৈধ স্থাপনায় মুখ থুবড়ে ত্রিদেশীয় রেল ট্রানজিট
চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর রেলস্টেশনের দুই পাশের জায়গা দখল হয়ে গেছে। অবৈধ স্থাপনার কারণে সংকীর্ণ হয়েছে প্ল্যাটফর্মের এলাকা। সম্প্রতি তোলা সমকাল
এ কে এস রোকন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২৬ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:৩৫
চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর রেলস্টেশনে পূর্ণাঙ্গ রেলবন্দর স্থাপন করতে প্রধান বাধা অবৈধ স্থাপনা। রেলওয়ের শত শত বিঘা জমি রক্ষা করতে গঠিত কমিটির একাংশের বিরুদ্ধেও রয়েছে দখলের অভিযোগ। পরিস্থিতি এতটা ঘোলাটে যে, ৫ আগস্টের পর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গিয়ে পিছু হটেছে কর্তৃপক্ষ। এ কারণে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ত্রিদেশীয় রেলওয়ে ট্রানজিট রুট মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৩০ বছর আগে শুরু হওয়া রহনপুর-সিঙ্গাবাদ রেলরুট দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের সীমান্ত বাণিজ্য এখনও চালু রয়েছে। গত আওয়ামী লীগ সরকার নেপালের সঙ্গে থাকা ট্রানজিট চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। সে মোতাবেক নেপালকে বাংলাদেশের ট্রানজিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ত্রিদেশীয় বাণিজ্যের দ্বার খুলে যাবে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারায় আমদানিকারকরা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাচ্ছেন না।
এদিকে নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি চিফ মিস ললিতা সিলওয়াল গত বৃহস্পতিবার রহনপুর স্টেশনের ট্রানজিট পয়েন্ট পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, পণ্য পরিবহনের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ও ভারতের সিঙ্গাবাদ রেলপথ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করতে চায় নেপাল।
নেই ন্যূনতম অবকাঠামো
ভোলাহাট, রহনপুর ও নাচোল উপজেলার এ রুটে যাত্রীর চাপ রয়েছে। তবে যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য একটি লাইন, যাত্রী ছাউনি না থাকা, সন্ধ্যার পর রাজশাহী থেকে ফেরার ট্রেন না থাকা এবং সীমাবদ্ধতায় নতুন ট্রেন দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। পণ্য পরিবহনে দুটি লাইন থাকায় ভারত ও নেপাল থেকে দিনে সর্বোচ্চ দুটি মালবাহী ট্রেন অবস্থান করতে পারে। এ ছাড়া পার্কিং সুবিধা, ওয়্যারহাউসসহ বন্দরের অবকাঠামো নেই।
রহনপুর স্টেশন মাস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে রেললাইন চালু থাকায় আন্তর্জাতিক রেললাইন স্থাপনে কোনো খরচ হবে না। শুধু স্টেশন এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ এবং ত্রিদেশীয় ট্রানজিট চালু হলে এ বন্দরকে দেশের বৃহত্তম রেলবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
এ রুটের নিয়মিত যাত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জেম জানান, স্টেশন চত্বরে পার্কিং এলাকা, যাত্রী ছাউনি ও আরও লাইন সম্প্রসারণ করা দরকার।
ব্যবসায়ী ফারিকুল ইসলাম বাবু জানান, তারা পণ্য আনার পর রহনপুরে আনলোড করতে না পেরে আমনুরা বা আরও দূরে গিয়ে তা খালাস করে থাকেন। এতে ব্যবসায়ীরা বন্দরটি ব্যবহারে উৎসাহ পান না।
১৩২ একর জমি বেদখল
বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের ভূসম্পত্তি বিভাগ জানায়, গোলাবাড়ী থেকে রহনপুর হয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী শিবরামপুর পর্যন্ত রেলের ৩৭৮.৮৮ একর জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে রহনপুর রেলওয়ে স্টেশন ও এর আশপাশে ১৪৭.৮৪ একর জমি রেলের দখলে। এ ছাড়া ৯৮.৭৩ একর জায়গা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য ইজারা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাকি ১৩২.৩০ একর জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে।
দখলদারদের তালিকা
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, রেলের জায়গা ব্যবসায়ী সংগঠন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের দখলে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন রহনপুর স্টেশন বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি আশরাফুল ইসলাম, সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ সদস্য হালিমা বেগম, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক পৌর মেয়র মতিউর রহমান খান, গোমস্তাপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম তুহিন, বিএনপি কর্মী সাইফুল ইসলাম ডাবলু এবং জামায়াতের রুকন সানোয়ার হোসেন ও জামায়াত কর্মী আশরাফুল ইসলাম আশরাফ।
এ ছাড়া রহনপুর কলেজ মোড় এলাকার চার দখলদার রেলওয়ের জলাশয় দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে এবং ইজারার কয়েক গুণ বেশি জায়গা অবৈধ দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণসহ ব্যবহার বা ভাড়া দিয়েছেন। রেলস্টশনের পশ্চিম দিকের আমের বাজার ও পূর্ব দিকের রেলের জায়গা দখল করে দৈনিক বাজার বসিয়ে রহনপুর পৌর কর্তৃপক্ষ বছরে প্রায় কোটি টাকা খাজনা আদায় করছে। এ নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ পৌরসভাকে আইনি নোটিশ দিয়েও লাভ হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রেলের জমিতে মাদক ও অনৈতিক ব্যবসা চালাচ্ছে একটি প্রভাবশালী চক্র।
ব্যবসায়ী নেতা আশরাফুল ইসলাম শশী হার্ডওয়্যার, গোডাউনসহ প্রায় ১০-১২টি মেসঘর নির্মাণ করেছেন। ওষুধ ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ কর্মী মোহাম্মদ হোসেন মার্কেট তৈরি করে পাইওনিয়ার ড্রাগ হাউস, রহনপুর বুক ডিপো, সাব্বির কম্পিউটার, নিউ ফ্যাশন অ্যান্ড গার্মেন্টস, দিগন্ত কম্পিউটার, রেজা স্টেশনারি, নাদিম সু কালেকশন, হক অ্যান্ড সন্স গার্মেন্টস, সুশীল স্যালুনসহ পেছনে তিনটি গুদামঘর ও সমপরিমাণ জায়গা দখলে রেখেছেন। সানোয়ার হোসেন প্ল্যাটফর্মসংলগ্ন জায়গায় শিলা কসমেটিকস, সেলিম ইলেকট্রনিকস, তরিকুল মেকানিকসের নামে দুটি দোকানঘরসহ তাঁর বাসাসংলগ্ন রেলের জায়গায় ২০টি সবজির আড়ত তৈরি করে মাসিক ভাড়া বাবদ আদায় করছেন ৩৫ হাজার টাকা।
বিএনপি নেতা আবদুস সালাম তুহিন পাকা মার্কেট নির্মাণ করে আশা বস্ত্রালয়, আশিক বস্ত্রালয়, গুডলাক টেইলার্সকে পজেশন বিক্রয়সহ ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া তাঁর বাসাসংলগ্ন রেলের জায়গায় শামীম ট্রেডিং করপোরেশনসহ একটি বড় গুদাম ও তিনটি দোকানঘর রয়েছে। সাইফুল ইসলাম ডাবলুর দখল করা সুইটি গার্মেন্টস, সুমন ফ্যাশন, বিপ্লব কম্পিউটারসহ চারটি দোকানঘর। তেল ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলামের দখলে শরিফুল ইলেকট্রনিকস, নিউ রেহান ফ্যাশন, আলিম টেলিকম, বিসমিল্লাহ ইলেকট্রনিকসহ বড় একটি গুদামঘর রয়েছে। রহনপুর কলেজ মোড় এলাকার দখলদার হাবিবুর রহমান হবি, মেহেদী হাসান, আকবর হাজী, রফিকুল ইসলাম রেলওয়ের জলাশয় দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন।
জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হালিমা খাতুন হঠাৎপাড়ায় রেলের জায়গায় তিনটি বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া তুলছেন। পলাতক থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া না গেলেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রেলওয়ের জমিতে প্রায় ১০০ বাড়ি রয়েছে। সরকারের জমি যখন প্রয়োজন হবে, তখন আমরা বাড়ি সরিয়ে নেব।
অভিযুক্ত দখলদারদের সবাই রেলের জমি অবৈধভাবে দখলে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা জানান, নিয়ম মেনে লিজ নিয়েছেন রেলের জমি। অবশ্য প্রতিবছর নবায়ন করার কথা থাকলেও নবায়ন না করার বিষয়টি স্বীকার করেন। তারা আরও জানান, রেলবন্দর স্থাপনে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে প্রয়োজনে তারা জায়গা ছেড়ে দেবেন।
রাজস্ব বাড়ার সম্ভাবনা
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ স্টেশনে যাত্রীসেবা বাবদ ১ কোটি ৮৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬৬৭ এবং মাল পরিবহন বাবদ ৩০ কোটি ৩৩ লাখ ৬২ হাজার ৯২১ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যাত্রীসেবা বাবদ ২ কোটি ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৮৮৮ এবং মাল পরিবহন বাবদ ২১ কোটি ৯৯ লাখ ৮৯ হাজার ৩১৮ টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার। পণ্য পরিবহন বাড়লে রাজস্ব আদায় আরও বাড়বে বলে মনে করছেন স্টেশন-সংশ্লিষ্টরা।
উচ্ছেদ ব্যর্থ হওয়ার নেপথ্যে
স্থানীয়রা জানান, রহনপুর রেলবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে আন্দোলন বেগবান করতে জামায়াত, বিএনপি, আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১৫ সদস্যের কমিটি করা হয়। এর মধ্যে পাঁচজন জমি দখলে অভিযুক্ত। এদের বিরুদ্ধে কমিটির সিদ্ধান্ত অন্য দখলদারদের কাছে পাচার করে আন্দোলনকে ব্যর্থ করার অভিযোগ রয়েছে। কমিটির কয়েকজন নেতা আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকার পাশাপাশি দখলদারদের সমর্থন জুগিয়েছেন।
কয়েক দফা চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ স্টেশনের সামনে পার্কিংয়ের জন্য গত ২৬ সেপ্টেম্বর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগ। এদিন অর্ধশতাধিক দোকানপাট উচ্ছেদের পর বাধার মুখে উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত করে দেয় কর্তৃপক্ষ। উল্টো হামলা হয় কর্তৃপক্ষের ওপর। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাজশাহী রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. বাবুল আখতার উচ্ছেদ করা জায়গায় পুনরায় দোকান নির্মাণ এবং অভিযানে বাধা দেওয়ার অভিযোগ দেন রাজশাহী রেলওয়ে থানায়। সে সঙ্গে উচ্ছেদ করা জায়গায় দখলবাণিজ্য বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও উল্টো উচ্ছেদ করা স্থান পুনর্দখল করে ১৫টি দোকান পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট নুরুজ্জামান জানান, রেলওয়ের জায়গা এক বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়। ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয় না। লিজ দেওয়া জায়গাগুলো প্রতিবছর নবায়ন করার কথা থাকলেও কেউ ঠিকমতো নবায়ন করে না।
রহনপুর রেলবন্দর বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক নাজমুল হুদা খান রুবেল বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা আন্দোলন ও দখল দুটোতে সামনে থাকেন। এ কারণে রেলবন্দর বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে পশ্চিম রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, গত ২৬ সেপ্টেম্বর উচ্ছেদ শুরু হয়। অথচ ৩ ঘণ্টার মাথায় তা পণ্ড হয়ে যায়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।
তবে পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক মামুনুল ইসলাম জানান, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে সেদিন উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। পুনরায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
- বিষয় :
- অবৈধ কার্যক্রম
- রেল
- চাঁপাইনবাবগঞ্জ