ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

সার সিন্ডিকেটে পেঁয়াজ চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ

সার সিন্ডিকেটে পেঁয়াজ চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ

জমিতে রোপণের জন্য পেঁয়াজের চারা তুলছেন কৃষক শ্রমিক। ছবি: সমকাল

মিজানুর রহমান নয়ন, কুমারখালী (কুষ্টিয়া)

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৭:৫৭

২০২৪ সালজুড়েই ঝাঁজ ছিল পেঁয়াজের বাজারে। মৌসুমের শুরুতে ৩৫-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। সেই পেঁয়াজ কয়েকমাস আগে বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। আর প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ পড়েছে ১৮-২৫ টাকা। ফলে খরচ বাদ দিয়েও লাভ রয়েছে চাষিদের। তাই চলতি অর্থবছরে আবারও এ ফসল আবাদে আগ্রহ দেখা গেছে চাষিদের মধ্যে। মাঠে মাঠে পেঁয়াজের চারা রোপণে ধুম পড়েছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলাতে।

তবে কৃষকদের দাবি, ডিলারদের সিন্ডিকেটের কারণে ভরা মৌসুমেও চাহিদামতো নন ইউরিয়া টিএসপি, এমওপি এবং ডিওপি সার পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ সার পেলেও তাদের গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। এতে চরম ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় মোট কৃষিজমির পরিমাণ ১৮ হাজার ২৪০ হেক্টর। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমি পেঁয়াজ চাষাবাদের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুই হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। বছরজুড়ে ভালো দাম পাওয়ায় পেঁয়াজ আবাদে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মধ্যে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত জমিতে পেঁয়াজ চাষাবাদের প্রত্যাশা করছে কৃষি বিভাগ। জমি ভাড়া, বীজ, সার, চাষ ও পরিচর্যা বাবদ এবছর প্রতি হেক্টরে খরচ পড়ছে প্রায় এক লাখ ৫১ হাজার টাকা।

গত বছরের ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর উপজেলার যদুবয়রা, পান্টি, বাগুলাট ও চাপড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়- কৃষক, শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সী ১৫ থেকে ২০ জন দলবদ্ধভাবে চারা রোপণ করছেন।

তারা জানান, চারা রোপণের ভরা মৌসুমে শ্রমিক চরম সংকট থাকে। এ সময় শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ নিজেদের জমিতে আবার অনেকে খরচ মেটাতে ৪০০-৫০০ টাকা মজুরিতে মাঠে কাজ করেন।

যদুবয়রা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক আবু বাদশা বলেন, গত বছর সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে প্রায় ৪৫০ মণ পেঁয়াজ হয়েছিল। বছরজুড়েই পেঁয়াজের ভালো দাম ছিল। প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ১৩৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। লাভ হওয়ায় এবছরও প্রায় দশ বিঘা জমিতে চারা রোপণ করছি। তার দাবি, বেশি টাকা দিয়েও পর্যাপ্ত সার পাওয়া যাচ্ছে না।

জোতমোড়া গ্রামের নীলের মাঠের কৃষক তোয়াফেল হোসেন বলেন, ডিলারের কাছে গেলেই বলে সার নেই। বারবার ঘুরেই ৮০ কেজি টিএসপির বদলে ২০ কেজি, ৭৫ কেজি করে এমওপি এবং ডিওপির বদলে মাত্র ১৫ কেজি করে সার পেয়েছি। আড়াই বিঘা জমিতে চারা রোপণ করছি। বিঘাপ্রতি খরচ পড়ছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ মণ ফলনের প্রত্যাশা তার।

একই গ্রামের কৃষক লায়েব আলী বলেন, যদুবয়রা ডিলারের কাছে বারবার গিয়েও সার পাইনি। বরং ডিলার অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। পরে স্থানীয় এক মুদি দোকানির কাছ থেকে এক হাজার ৩৫০ টাকা বস্তার (৫০ কেজি) সার এক হাজার ৮০০ টাকায় কিনেছি।

চাপড়া ইউনিয়নের ভাঁড়রা গ্রামের কৃষক মোসাদ্দেক আলী সাড়ে তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, বাঁশগ্রাম বাজারের সাব ডিলার রেজাউলের কাছে সার কিনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ডিলার সার দেননি। পরে ওই ডিলারের কাছ থেকেই একজন সার বিক্রেতার মাধ্যমে সার নিয়েছি। এতে এক হাজার ৩৫০ টাকা বস্তার বাংলা টিএসপিতে লেগেছে ৩ হাজার ৩৫০ টাকা, এক হাজার টাকা মূল্যের এমওপি সারের বস্তায় লেগেছে এক হাজার ২০০ টাকা এবং এক হাজার টাকা বস্তা এমওপি সারের বস্তায় লেগেছে এক হাজার ৪৪০ টাকা।

তার ভাষ্য, কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করছে না ডিলাররা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেশি দামে সার বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন ডিলাররা।

অভিযোগ অস্বীকার করে বাঁশগ্রামের সাব ডিলার রেজাউল ইসলাম ফোনে বলেন, মোবাইলে সব কথা বলা যায় না। পরে তিনি প্রতিবেদককে গোপনে দেখা করতে বলেন।

আর যদুবয়রা ইউনিয়নের বিসিআইসি সারের ডিলারের ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন বলেন, সরকারিভাবে চাহিদা অনুযায়ী সারের সরবরাহ নেই। সেজন্য কৃষকদের তিনি চাহিদা অনুযায়ী সার দিচ্ছেন না। তবে দাম বেশি নিচ্ছেন না তিনি। চলতি মাসে যদুবয়রা ইউনিয়নে টিএসপি সারের প্রয়োজন প্রায় তিন হাজার বস্তা। সেখানে বরাদ্দ পেয়েছেন মাত্র ৩১৮ বস্তা।

সার সংকটের কথা স্বীকার করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাইসুল ইসলাম বলেন, বছরজুড়ে পেঁয়াজের ভাল দাম থাকায় এ চাষে আগ্রহ বাড়িয়েছে কৃষকরা। চাহিদা অনুযায়ী সারের সরবরাহ না থাকায় সংকটে পড়েছেন কৃষকরা। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

সার নিয়ে ডিলাররা কোনও সিন্ডিকেট করলে তা খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম।

তিনি বলেন, কৃষকরা মৌখিকভাবে সার সংকটের কথা জানিয়েছেন। সমস্যা সমাধানে কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা ও বিএডিসির সঙ্গে আলাপ চলছে।

আরও পড়ুন

×