ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

পরীক্ষা কম, মিলছে না করোনার বাস্তব চিত্র

পরীক্ষা কম, মিলছে না করোনার বাস্তব চিত্র

প্রতীকী ছবি

তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২২ | ১৫:০২

করোনার নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহ কমছে। লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে সেগুলো সাধারণ সর্দি, জ্বর বা মৌসুমি রোগব্যাধি মনে করে পরীক্ষা করাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। ফলে করোনার বাস্তব চিত্র মিলছে না। এমন পরিস্থিতিতে গোলকধাঁধায় দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও দেশে ভাইরাসের গতি-প্রকৃতির সঠিক কোনো চিত্র নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের হারের ওপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণ করা হয়। টেস্টের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাস্তবের সঙ্গে সরকারের দেওয়া করোনার তথ্যের মিল নেই। ফলে ৬ দফা নির্দেশনা দিয়ে দায় এড়িয়েছে সরকার। এ ছাড়া ওমিক্রনের উপধরনের উপসর্গ মৃদু হওয়ায় আক্রান্ত অনেকের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। ফলে একটি পরিবারের সবাই সংক্রমিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাঁরা বলছেন, গ্রাম থেকে উপজেলা শহরে গিয়ে পরীক্ষা করানো, যাতায়াত ব্যয়, যোগাযোগ সহজ না হওয়াসহ নানা কারণে নমুনা পরীক্ষায় বেশি পিছিয়ে থাকছেন গ্রাম এলাকার মানুষ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নতুন ভ্যারিয়েন্ট এলে পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে। এ বিষয়ে এখনই বিশেষ নজর দিতে হবে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু মানুষ আগ্রহী না হওয়ায় তারা অলস সময় পার করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, শনিবার ২২ জেলায় একটিও নমুনা পরীক্ষা হয়নি। গত ২৪ ঘণ্টায় ৯০টি কেন্দ্রে কেউ যায়নি। এ ছাড়া ঈদের আগে দৈনিক ১৩ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হলেও সেটি এখন কমে ৬ হাজারে নেমেছে। গত কয়েক দিনে করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে সিলেটসহ যেসব এলাকায় বন্যা হয়েছে, সেসব এলাকার পরিস্থিতি আরও নাজুক। এসব এলাকায় টিকাদান কর্মসূচি ও নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।

নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় দেশে চার দিন পর দৈনিক শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা এক হাজারের নিচে নেমেছে। এ সময় মৃত্যু হয়েছে চারজনের। রোববার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৮ হাজার ৯১টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯০০ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। নতুন শনাক্ত ৯০০ জনের মধ্যে ৪৬৬ জনই ঢাকা জেলার বাসিন্দা। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৩ জেলাতেই গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী ধরা পড়েছে। এ সময় মারা যাওয়া চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা। এ ছাড়া একজন চট্টগ্রাম বিভাগের, একজন রাজশাহী বিভাগের ও একজন খুলনা বিভাগের। তাঁদের দু'জন পুরুষ ও দু'জন নারী।

নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার কমে ১১ দশমিক ১২ শতাংশ হয়েছে। আগের দিন এই হার ছিল ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ৩১ দিন নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের ওপরে থাকল। করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত ১৬ জুন প্রথমবারের মতো পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ শতাংশ ছাড়ায়।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, গত এক মাস ধরেই লক্ষ্য করছি টেস্ট কম হচ্ছে। টেস্ট অনুযায়ী আক্রান্তের যে সংখ্যা আমরা পাচ্ছি, প্রকৃত সংখ্যা তার কয়েক গুণ বেশি। অনেকেই হয়তো আক্রান্ত হয়ে গেছেন। মৃদু লক্ষণ ছিল বা লক্ষণ নেই। অনেকেই আবার এমনি এমনিই ভালো হয়ে গেছে। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এ রকম সংখ্যা বেশি মনে হয়।

তবে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই এটুকু বলা যায়। অনেকেই টিকা নেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানায় উদাসীনতা দেখাচ্ছেন। লক্ষ্য রাখতে হবে, অ্যান্টিবডি কিন্তু স্থায়ী নয়। কত দিন এটা সুরক্ষা দেবে, কেউ জানে না। সুতরাং কেউ যেন অ্যান্টিবডির কথা ভেবে উদাসীন ভাব না দেখায়। সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় পরামর্শ কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশের ১২ কোটি মানুষ এখন টিকার আওতায় এসেছে। যে কারণে চতুর্থ ঢেউ বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ঈদের সংক্রমণ বিস্তারের যতটা ভয় করা হয়েছিল, অতটা হয়তো হবে না। করোনা নিয়ন্ত্রণে সিলেটসহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এসব এলাকা এখনও পরীক্ষা বন্ধ হয়ে রয়েছে। বন্যা-পরবর্তী এসব এলাকায় সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেখানে ক্যাম্পেইন করে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন সমকালকে বলেন, ঈদের পর সংক্রমণ কিছুটা হলেও বাড়ছে। গ্রামে গ্রামে এখন করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ঢাকার মতো হঠাৎ করে সংক্রমণ বাড়েনি। এমনকি সেভাবে নমুনা পরীক্ষা করাও সম্ভব হয়নি। সেই কারণ হয়তো পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না। এমনকি করোনা বাস্তব তথ্যও পাচ্ছি না।

তিনি আরও বলেন, নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে বিনামূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে তাদের নিম্ন আয়ের মানুষের বিষয় মাথায় রেখে রাশিয়ার মতো আক্রান্তদের ১২ দিন খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে। একটা কথা সবার মনে রাখতে হবে, করোনা শেষ হয়ে যায়নি। যে কোনো একটা নতুন ধরন পরিস্থিতি ভয়ানক করে দিতে পারে। ফলে আমাদের টিকাদান অব্যাহত রাখতে হবে। কেন মানুষ পরীক্ষা করাতে অনীহা দেখায়, তা খুঁজে বের করতে হবে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলে সঠিক পরিকল্পনা করা যায় না। আর পরিকল্পনা না থাকলে তা বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে।

আরও পড়ুন

×