সংসদীয় কমিটিতে প্রতিবেদন
ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে শঙ্কা

সমকাল প্রতিবেদক ও চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২০:৩১
ডলার সংকটের কারণে আমদানি জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে দেরি হচ্ছে। আর এতে দিন দিন বাড়ছে বকেয়া। এ অবস্থা চলতে থাকলে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জ্বালানি বিভাগ। গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়।
এর আগে, জ্বালানি বিভাগে দেওয়া এক চিঠিতে ডলার সংকটে পড়ার কথা জানায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। চিঠিতে বলা হয়, ডলারের অভাবে বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় চুক্তি অনুযায়ী তেল দিতে রাজি হচ্ছে না বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বকেয়া পরিশোধ ছাড়া তারা তেল দেবে না। ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপিসির দেনা দাঁড়িয়েছে ৪০৭ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার! প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে যা ৪ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার বেশি!
সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া প্রতিবেদনে জ্বালানি বিভাগ বলে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপিসির আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ডলার সংকটে জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে ১০ থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত দেরি হচ্ছে। এতে বাড়ছে বকেয়ার পরিমাণ। এ অবস্থা চলতে থাকলে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হতে পারে। বেসরকারি কিছু ব্যাংক দুই বছর ধরে ঋণপত্র (এলসি) খুলছে না উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপিসি শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি করছে। মাসে সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টন পরিশোধিত এবং এক লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে।
অন্যদিকে সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্য বাড়ানো প্রয়োজন। পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১ টাকা বাড়ালে বছরে ভর্তুকি কমবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের স্বল্পতা, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং রেন্টাল থেকে ক্রয়-বিক্রয়ের পার্থক্য বাবদ চলতি অর্থবছরে ৩৫ হাজার থেকে ৩৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। তবে গ্যাস উত্তোলন দিনে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়লে ঘাটতি কমবে ৬ হাজার কোটি টাকা।
সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে কমিটি সদস্য ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, আ স ম ফিরোজ, হাফিজ আহমদ মজুমদার, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, পনির উদ্দিন আহমেদ, ফেরদৌসী ইসলাম এবং মোকাব্বির খান অংশ নেন।
বৈঠকে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা এবং ডলার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সময়োচিত পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা হয়। সংসদীয় কমিটি শুধু আমদানিনির্ভর না থেকে জ্বালানির দেশি উৎস অনুসন্ধানে জোর দিতে বলে।
বকেয়া পরিশোধ ছাড়া তেল দিচ্ছে দু্ই কোম্পানি
জ্বালানি বিভাগে দেওয়া বিপিসির চিঠিতে বলা হয়, ডলারের জোগান নিশ্চিত করতে না পারলে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যাহত হবে। গত সোমবার জরুরি এ চিঠি দেন বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তেল আমদানির বিপরীতে বকেয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মুহাম্মদ মুজাম্মেল হক এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি বিপিসির একান্তই অফিসিয়াল।’
বিপিসির চিঠিতে বলা হয়, গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিটল ও বিএসপি তাদের পাওনা পরিশোধে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। ভিটল ও বিএসপি সেপ্টেম্বরের বাকি সময় ও অক্টোবরে যদি কার্গো সরবরাহ না করে, তাহলে নিরবচ্ছিন্ন তেল সরবরাহ সম্ভব হবে না।
বিপিসির একটি সূত্র জানায়, ভিটলের চিঠিতে বলা হয়েছে– ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপিসির কাছে তাদের পাওনা ১৯ কোটি ৮৮ লাখ ৪৬ হাজার ডলার। এই বকেয়ার কারণে বিপিসি থেকে ইস্যু করা এলসি তারা নিশ্চিত করবে না। জটিলতা এড়াতে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ধাপে ধাপে হলেও ১১ কোটি ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ডলার পরিশোধের অনুরোধ জানায় সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান ভিটল। বকেয়া পরিশোধ না হলে ‘বিলম্বজনিত সুদ’ আরোপ করার কথাও চিঠিতে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি অক্টোবরের জন্য বিপিসির চাওয়া সব কার্গো বাতিল এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে।
আর ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠান বিএসপি তাদের চিঠিতে উল্লেখ করে, ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপিসির কাছে তাদের পাওনা ৭ কোটি ১ লাখ ২৭ হাজার মার্কিন ডলার। এই বকেয়া ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ধাপে ধাপে পরিশোধের করতে বলে তারা। অন্যথায় সেপ্টেম্বরের বাকি সব কার্গো বাতিল হবে বলে জানায়।
প্রতি মাসে তেলের সম্ভাব্য চাহিদা অনুযায়ী আমদানি সূচি নির্ধারণ করে বিপিসি। সেই অনুযায়ী, অন্তত ৩০ দিন আগে তেল সরবরাহকারী সব প্রতিষ্ঠানে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়। চলতি মাসের বাকি সময়ে বিএসপির ৫০ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহের কথা রয়েছে। আর অক্টোবরের প্রস্তাবিত আমদানি সূচি অনুযায়ী, দুই দফায় প্রতিষ্ঠানটি ৮০ হাজার টন তেল সরবরাহ করার কথা। অক্টোবরে ভিটল পাঁচটি পার্সেলে সরবরাহ করার কথা ১ লাখ ১৫ হাজার টন ডিজেল ও ৩৫ হাজার টন জেড ফুয়েল।