দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একের পর এক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হওয়ায় পুরো প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত বুধবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় পটুয়াখালীর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর আগেও দু'জন উপপরিচালককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা না হলেও কমিশন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তারা দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

সর্বশেষ উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির ঘটনায় সারাদেশে দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ব্যাপক উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তারা বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করেছেন। তারা অভিযোগ করেন, যারা ভালো কাজ করছেন, দুদকে তাদের ঠাঁই হচ্ছে না। দুদক কর্মচারী বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪(২) ধারায় শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী কমিশন যে কোনো সময় যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অপসারণ করতে পারে। এই ধারা নিয়ে দুদকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর আগেও একই ধারায় একাধিক কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযোগ সম্পর্কে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুতির ধারা অব্যাহত থাকলে কমিশনের সারাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রয়োজনে কর্মবিরতি পালন করবেন। এই অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ কাজে ভাটা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অতীতে আলোচিত, জনপ্রিয় সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট মো. রোকন-উদ-দৌলা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মুনীর চৌধুরীকে সরে যেতে হয়েছিল। ভেজাল ও দুর্নীতিবিরোধী তাদের বলিষ্ঠ অভিযানের কারণে নানা পর্যায়ের প্রভাবশালীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন তারা। কথিত আছে প্রভাবশালীদের চাপেই তাদের নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে বদলি করে অন্য দপ্তরে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা বিএসটিআইতে থাকাকালে ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে অনেক শিল্পপতির ভিত কাঁপিয়েছেন। পরে তাকে মিল্ক ভিটায় বদলি করা হয়। এরপর বদলি করা হয় রাজউকে। আর দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মুনীর চৌধুরী এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠন করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছেন। বর্তমানে রোকন-উদ-দৌলা অবসরে আছেন। মুনীর চৌধুরী বর্তমানে বিজ্ঞান জাদুঘরের দায়িত্বে আছেন।

শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি নিয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন গতকাল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, শরীফ উদ্দিন দুদক কর্মচারী চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী যা মানা প্রয়োজন সেগুলো না মেনে অব্যাহতভাবে এই বিধির পরিপন্থি কাজ করে আসছিলেন। এই কারণে কমিশন মনে করেছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে এবং সবাই যাতে সঠিকভাবে কাজ করেন সে লক্ষ্যে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। শরীফ উদ্দিন আইনের বাইরে অনেক কাজ করেছেন, সেজন্যই চাকরিবিধির ৫৪(২) ধারাটি তার ক্ষেত্রে কার্যকর করা হয়েছে। তার মানে এই নয়, ৫৪(২) ধারাটি সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। এটি একেবারে শেষ এবং চরম পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়। শরীফ উদ্দিনের বিষয়টি তারই অংশ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সচিব আরও বলেন, শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু ছিল, আরও অভিযোগ এসেছে, আরও আসছিল। তার সম্পর্কিত একটি তদন্তে দুর্নীতির টাকা উদ্ধারকালে তিনি যে কাজ করেছিলেন তাতে হাইকোর্ট থেকেও সে বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। সবকিছু মিলিয়ে চাকরিবিধি পরিপন্থির কাজের কারণেই তাকে অপসারণ করা হয়েছে।

এর আগে কমিশন দুদকের সাবেক উপপরিচালক আহসান আলী ও শফিকুল ইসলামকে চাকরি বিধিমালার ৫৪(২) ধারায় অপসারণ করেছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক কর্মচারী বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪(২) ধারা প্রবর্তন করা হয় এক-এগারোর পর তৎকালীন সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। এই ধারা অনুযায়ী কমিশন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন মাসের নোটিশ বা তিন মাসের বেতন দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে অপসারণ করতে পারে।

বিগত দিনে অপসারিত দুদকের সাবেক উপপরিচালক আহসান আলী ওই ধারাটি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। তার রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ধারাটি বাতিল করেছিলেন। এরপর দুদক হাইকোর্টের ওই বাতিলের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। এই আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। এরপর থেকে ধারাটি আবারও বলবৎ হয়। লিভ টু আপিলের আবেদন এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করা হয়নি।

মানববন্ধন: শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের প্রতিবাদে দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গতকাল প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন। এটি দুদকের ইতিহাসে নজিরবিহীন। মানববন্ধনে উপস্থিত থাকা দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সহকর্মী শরীফ উদ্দিনকে ৫৪(২) ধারায় অপসারণ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কর্মকর্তারা অনুসন্ধান, তদন্ত এবং কাজ করতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, কমিশন যৌক্তিকতা সহকারে সমস্যাগুলো দেখবে। কর্মকর্তারা যেসব সমস্যার মুখোমুখি সেসব সচিব মহোদয়কে জানানো হয়েছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, খুব দ্রুত সমস্যাগুলো সমাধান করার।

স্মারকলিপি: শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের ঘটনায় দুদক কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির সচিব মাহবুব হোসেনের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। এতে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের আদেশ ও বিতর্কিত বিধিমালাটি বাতিলের দাবি জানানো হয়। আরও বলা হয়, শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি তার চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত থাকাকালে ৫২টি মামলা দায়ের করেন। ১৫টি চার্জশিট দাখিল করেন। তিনি কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উদ্ঘাটনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান, তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।