সাধারণত উৎসব আয়োজনকে ঘিরে দাম বাড়ে মসলার। তবে এবার আমদানি সরবরাহ ঘাটতিসহ নানা কারণে মসলা পণ্যের দাম বেড়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মসলার মধ্যে রসুন, আদা, মরিচ ও হলুদের দাম একসঙ্গে বেড়েছে। তবে বাজারের সব রেকর্ড ভেঙে বেশ কিছুদিন ধরে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে এলাচ।

এ ছাড়া চালসহ কিছু নিত্যপণ্য কিনতে চড়া দাম গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বাজারে একসঙ্গে এত বেশি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি ব্যয়ের চাপে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

এখন দেশি মরিচের মৌসুম শেষ পর্যায়ে। এ কারণে দেশি শুকনা মরিচের সরবরাহ কমেছে। এ সুযোগে আমদানি করা ভারতীয় শুকনা মরিচের দাম হুহু করে বাড়ছে। গত ডিসেম্বরে শুকনা মরিচ ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি। এর পরে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে এখন ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা প্রতি কেজি। সপ্তাহের ব্যবধানে হলুদের দামও কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ২৭০ টাকায় উঠেছে। খুচরা বাজারে রসুনের কেজির দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। গতকাল প্রতি কেজি দেশি পুরোনো রসুন ২২০ টাকায় বিক্রি হয়। যা আগের সপ্তাহে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা ছিল। দেশি নতুন রসুন বাজারে আসার পরে আগের সপ্তাহে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা ছিল। এখন তা দ্বিগুণ বেড়ে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা চীনা রসুনও একই হারে দাম বেড়ে এখন ২০০ টাকা কেজি। বাজারে বেড়েছে আদার দামও। কেজিতে ৪০ থেকে ৬০ টাকা বেড়ে মানভেদে চীনা আদা ১৮০ থেকে ২২০ টাকায় উঠেছে। প্রায় একই হারে বেড়ে দেশি আদা ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়  বিক্রি হচ্ছে।

পেঁয়াজের দাম ওঠানামার মধ্যে রয়েছে। আগের সপ্তাহে কিছুটা কমলেও গত দু'দিন ধরে আবার বাড়ছে পেঁয়াজের দামও। চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমেছে। বর্তমানে বাজারে চীনা পেঁয়াজ কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে। আর দেশি পেঁয়াজ ২০ টাকা বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরায় কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে চালের দাম। মানভেদে নাজিরশাইল চাল ৫০ থেকে ৬৫ টাকা, মিনিকেট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, মোটা (স্বর্ণা ও গুটি) চাল ৩৫ থেকে ৩৭ টাকা হয়েছে এবং বিআর আটাশ, পাইজাম ও লতা (মাঝারি) চাল মানভেদে ৩৮ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আগের সপ্তাহে চাল রপ্তানিতে প্রণোদনার ঘোষণা দেয় সরকার। এর পরেই দাম বাড়ছে।

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আদা ও রসুন নিয়ে চিন্তিত না। কারণ বিকল্প বাজার থেকে এগুলো পাওয়া যাবে। হয়তো একটু বেশি দাম লাগতে পারে। এই মুহূর্তে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে তার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চীন থেকে আসছে। চায়না পেঁয়াজ বাংলাদেশিরা খুব একটা পছন্দ করে না। এই মুহূর্তে প্রতিদিন দুই হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। এর অর্ধেক আসছে মিয়ানমার থেকে। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আসছে পাকিস্তান থেকে। তুরস্ক, মিসর থেকেও আসছে। চীন থেকে আসছে খুবই কম। যদি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তাতেও অসুবিধা হবে না। মূল সমস্যা নিজেদের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। নিজস্ব উৎপাদন না বাড়ালে এ সমস্যা থাকবে। বছরের পর বছর পেঁয়াজ নিয়ে আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ৯০ ভাগই ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ভারত যখন বন্ধ করে দিল, তখন আর কোনো পথ ছিল না। সামান্য আসতো মিয়ানমার থেকে। একমাত্র সমাধান হচ্ছে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানো। উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের দাম দিতে হবে।

মন্ত্রী বলেন, চালের দাম বাড়লে কথা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কথা বলতে হবে, যাতে বাড়তি মূল্য কৃষকরা পান। নতুবা কৃষকরা উৎপাদনে উৎসাহ হারাচ্ছেন। গরুর মাংস আমদানি করা হলে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় খাওয়ানো যাবে। কিন্তু বাজারে ৫৫০ টাকায় মানুষ কিনে খাচ্ছে। এতে লাভ হয়েছে, দেশে গরুর উৎপাদন বেড়েছে। এমনকি কোরবানির সময়েও বিদেশি গরুর দরকার পড়ছে না। মন্ত্রী বলেন, পেঁয়াজের দাম কৃষকরা কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি পেলে আমদানি করা লাগবে না। প্রধানমন্ত্রী তাকে ও কৃষিমন্ত্রীকে বলেছেন, এমনভাবে কাজ করো, যাতে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পেঁয়াজ রপ্তানিকারক দেশ হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, রসুনের চিৎকার তেমন শুনিনি। লাগে কম। চীন থেকে আসে। মন্ত্রণালয় পর্যবেক্ষণে রেখেছে। প্রয়োজনে বিকল্প বাজার ভাবা হবে। আদা সামান্য দেশে হয়। বাকিটা আমদানি হয়ে থাকে। ফলে অন্য দেশ থেকেও আনা যাবে।

পরিস্থিতির সুযোগে ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার প্রবণতা আটকাতে কী করছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন চাপ দেন, তখন ব্যবসায়ীরা বলেন তারা যখন লোকসানে পড়েন তখন কেউ পাশে থাকে না। এ জন্য পদ্ধতি উন্নয়ন করতে হবে, যাতে তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে না পারেন। কারণ লাভ দেখলে ব্যবসায়ীরা ভালো হয়ে বসে থাকবেন তা কখনই হবে না।

পাইকারি বাজারে একই হারে দামে বেড়ে চীনা রসুন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি পুরোনো রসুন ২০০ টাকা ও নতুন রসুন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। চীনা আদার দামও কেজিতে ৫০ টাকা বেড়েছে। চীনা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজিতে। শুকনা মরিচ ৩৩০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পাইকারি আড়তে এ দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। অন্য পাইকারি বাজারেও প্রায় একই দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। পুরান ঢাকার শ্যামবাজার কৃষিপণ্য বণিক সমিতির সহসভাপতি ও আমদানিকারক মো. মাজেদ বলেন, চীন থেকে পেঁয়াজ, রসুন ও আদা আনতে নতুন করে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। আগে আমদানি করা এ মসলার সরবরাহ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ কারণে বাজারে রসুন ও আদার দাম বাড়ছে।

কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মাইনুল ইসলাম বলেন, দেশি নতুন রসুনের পর্যাপ্ত সরবরাহ হয়নি। দেশি রসুনের সরবরাহ বাড়ালে দাম কমে আসবে। তবে আদার আমদানি না বাড়ানো গেলে দাম কমানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, রমজান ঘনিয়ে আসছে। এর আগেই বাজারে সরবরাহ বাড়াতে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। না হলে দাম আরও বাড়তে পারে।

গরমমসলার বাজার গরম করেছে মসলার রানি এলাচ। দফায় দফায় বেড়ে দুই মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। আর বছরের ব্যবধানে চার গুণ বেশি দাম। এখন ভালো মানের এক কেজি এলাচ কিনতে ছয় হাজার টাকা গুনতে হয়। আর বাজারে সাধারণ এলাচ সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরায় অনেক দোকানদার ১০ থেকে ২০ টাকায় এলাচ বিক্রি করতে চান না। এতে বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।