- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বাংলাদেশের করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি
সমকালীন প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি

বাংলাদেশের করোনাকালীন অর্থনীতির অবস্থা ভালো নাকি মন্দ- এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সবাই যে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে বলেন তা নয়; রাজনৈতিক গবেষণায় দেখা যায়, নৈরাশ্যবাদী কথার এক বিরাট ভোক্তা আছে; তাই এই নৈরাশ্যবাদী কথা প্রচারের বিরাট এজেন্টও আছে। চাহিদা থাকলে জোগান থাকবেই। যাই হোক, একজন লোক অসুস্থ হলে যা হয়, তেমনি অর্থনীতি যদি কোনো অসুখে পড়ে তাহলে তার আকার কমে যাবে, আগের চেয়ে দুর্বল হবে, চলার গতি কমে যাবে- এটিও স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোটা দাগে দু'ভাবে ভাগ করা যায়। একটি হলো এর কৃষি খাত, আর অন্যটি হলো এর অকৃষি খাত। কৃষি খাতকে বলা যায় ভিত্তি কাঠামো এবং অকৃষি খাতকে বলা যায় উপরি কাঠামো। কৃষি খাতের অবস্থা কী? কৃষি খাতে প্রধান দুটি ফসল ধান ও গম উৎপাদন ব্যাহত হয়নি বরং তা ভালোই উৎপাদন হয়েছে। আবার অন্যদিকে করোনার মধ্যে কিছু ক্ষেত্র যেমন- দুধ উৎপাদন, হাঁস-মুরগির খামার, ফুল চাষ, সবজির মূল্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মোট কৃষি খাতের ৩-৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ জিডিপির তথ্যে দেখা যায়, কৃষি খাতের অবদান ১৩.০৭ শতাংশ, শিল্প খাতে ২৮.৫৪ শতাংশ এবং পরিষেবা খাতে ৫২.৯৬ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষি খাতের অবদান এত কম হওয়া সত্ত্বেও এটিকে এত গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কী কারণ আছে? তার অনেক কারণ আছে যেমন- সম্প্রতি পেঁয়াজের সরবরাহ ঘাটতির সময় এমনভাবে বাজার অস্থিতিশীল করা হয় যা দিয়ে দেশে একটি হাহাকার তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। সেখানে যদি চাল-আটার সামান্য সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়, তাহলে আমাদের 'চৌকস' ব্যবসায়ীরাসহ এক শ্রেণির মানুষ মিলে তিন সপ্তাহের মধ্যে দুর্ভিক্ষ তৈরি করার একটি সফল অভিযান শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উত্তমভাবে বুঝতে পেরেছেন এবং তিনি এ বিষয়ে অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি সচেতন আছেন। তাই বলা যেতে পারে, তিনি হচ্ছেন এ মুহূর্তে 'বেস্ট কিচেন ইকোনমিস্ট' যিনি 'উনুনের অর্থনীতি' খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। সম্ভবত তিনি নিজে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলে দেশের প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা হলেও বাড়ত।
আবার শিল্প খাত যদিও মোট জিডিপির ২৮.৫৪ শতাংশ; কিন্তু সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, ৩০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ উৎপাদন অব্যাহত ছিল। যেমন- ওষুধ শিল্প উৎপাদন এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিল। তবে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পড়েছে পরিষেবা খাত। তবে এই খাতের আবার সব ক্ষেত্র একরকম হয়নি। যেমন হাসপাতাল খাত প্রচুর ব্যবসা করেছে, আবার অনেক ডাক্তার চেম্বারেও বসেননি। আবার বিক্রয়-বিপণন খাতের মধ্যে এক অংশ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল এবং সে খাত বেশ ভালোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুদি দোকানের মতো প্রতিষ্ঠান কিছুটা ব্যবসা করেছে। আবার শহর এলাকায় এটি প্রধান ব্যবসা না হলেও গ্রাম এলাকায় এ ব্যবসাই প্রধান। অর্থাৎ শহরে দোকান খাতের ১৫ শতাংশ ব্যবসা করেছে। তৈরি শিল্প, স্পিনিং এবং টেক্সটাইল, চা শিল্প, পাট শিল্প, চামড়া, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন খাত সীমিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে এসব শিল্পের ওপর নির্ভরশীল উপখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে- বাংলাদেশের অর্থনীতির অতি ক্ষুদ্র অংশ যদি কৃষি খাত হয়, তাহলে তার স্বাস্থ্য দিয়ে কি গোটা অর্থনীতিকে মূল্যায়ন করা ঠিক? এ খাতে মোট কর্মসংস্থান হয় ৩৮ শতাংশ। দেশের খাদ্য উৎপাদন ইনডেক্স হচ্ছে ১৪৫ অর্থাৎ জমির তুলনায় প্রায় দেড় গুণ। ইতোমধ্যে অনেক অর্থকরী ফসল যেমন- কমলা, মালটা পর্যন্ত দেশে চাষ শুরু হয়েছে। তাই দেশের কৃষি খাত যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, তা হচ্ছে খোরাকি অর্থনীতি। এখনও মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ বাদ দিলে আর বাকি সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ খাত দ্বারা উপকৃত হয়। তার চেয়ে বড় কথা এই স্থায়ী সম্পদ থাকার কারণে মানুষ অনেক বেশি আর্থিকভাবে নিরাপদ মনে করে।
দ্বিতীয়ত, দেশের প্রায় সাড়ে ৩ দশমিক ৫ কোটির মধ্যে এক কোটি পরিবার প্রত্যক্ষভাবে রেমিট্যান্সের আওতায় রয়েছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৭-৮ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরেছে। এরা যে সবাই কপর্দকহীন হয়ে এসেছে এ কথা বলা যাবে না। রেমিট্যান্সের প্রবাহ তুলনামূলক এখনও বেশ ভালো আছে যা তাদের পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। যেমন- এপ্রিল মাসে আমি বলেছি রপ্তানি কমলে আমদানি তার চেয়েও বেশি কমবে। ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৩৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। রেমিট্যান্স কমার কথা প্রথমে পত্রিকাগুলো যেভাবে আশঙ্কা করেছে সেভাবে ঘটেনি।
বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা আভাস দিয়েছে- এ বছর প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশের বেশি হবে না। যদি তাই হয় মন্দ কি, এটি মাইনাস না হলেই ভালো। তাহলে বড় সংখ্যক ব্যক্তির অবস্থা তেমন খারাপ হবে না। তবে এটা সত্য যে, সব মানুষ একধরনের প্রভাবে পড়বে না। দেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র পেশাদার গোষ্ঠী রয়েছে (মোট পেশার সংখ্যা তিনশ'র বেশি) যারা নিঃসন্দেহে আর্থিক সংকটে আছে।
দেশের অর্থনীতিতে ভোক্তা ব্যয় হচ্ছে ৬৯ শতাংশ, যার মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ সচল রয়েছে। শহরে বসবাসরত প্রায় ২০-২৫ শতাংশ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে তাদের কেনাকাটা কিছুটা কমিয়ে হলেও অব্যাহত রেখেছে। আবার গ্রাম এলাকার মানুষেরও আয়-রোজগার কমে যাওয়ার কারণে হয়তো আগের মতো ততটা ক্রয় করছে না। কিন্তু একেবারে বন্ধ করার কোনো জোর নেই। বাংলাদেশের মানুষের একটি দুর্নাম আছে- তারা ঋণ করে হলেও ঘি খায় যা সংকটকালীন অর্থনীতির জন্য আবার ইতিবাচক একটি দিক।
এ করোনাকালে জুন মাসের মধ্যে আমাদের অর্থনীতি ৬০ শতাংশ, সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ৭০ শতাংশ (বর্ষার কারণে), ডিসেম্বর মাসে গিয়ে ৮৫-৯০ শতাংশ সক্রিয় হবে বলে আশা করা যায়। আমাদের দেশের দুটি বড় সামাজিক সম্পদ আছে, যার একটি হচ্ছে মানুষ যারা করোনাকে ভয় পেয়ে ভড়কে যায়নি, সবকিছু বন্ধ করে দেয়নি বরং সরকার চেষ্টা করেও তাদের কর্মচাঞ্চল্য বন্ধ করতে পারছে না। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এখানে মানুষ খরচ করে। ভারতের যেমন প্রধান সমস্যা হচ্ছে মদপান এবং খরচ না করা; আমাদের দেশে তা নেই। তাই এ অর্থনীতি চাঙ্গা হবেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি সবল অর্থনীতি বলে ধরে নিয়েছে 'ইকোনমিস্ট'সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী। তার কারণ মূলত বাংলাদেশের মানুষের আয় এবং ব্যয়ের ধরনের কারণে।
করোনা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলে বর্ষা মৌসুম শেষে অক্টোবরের পর আবার উন্নয়ন খাতের কর্মকাণ্ড পুরোদমে শুরু হবে। উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়, বিশেষ প্রণোদনার টাকা, করোনার জন্য বিশেষ বরাদ্দ, দাতা সংস্থার অতিরিক্ত বরাদ্দ, নভেম্বর মাসে ধান কাটা, বিভিন্ন উপরি পাওনার টাকা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন রকমের আয়, বর্ধিত রেমিট্যান্স (আশা করা যায় ওই সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে) ইত্যাদির টাকা চলে যাবে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মানুষের হাতে। বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা তখন আবার বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা ভাব থাকলে বাংলাদেশ তার সুবিধা পাবে। কারণ তখন কম দামি পণ্যের চাহিদা উন্নত বিশ্বে আরও বাড়বে।
একটি দেশের অর্থনীতি কেমন হবে সেটি কেবল অর্থনৈতিক সূচক নয়; আর্থিক কাঠামো, আয় কাঠামো, সম্পত্তি কাঠামো, পরিবার কাঠামো, জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, মানুষের আচরণ এবং পেশার ওপর নির্ভর করে। মার্কিনিরা মরছে তার পরও তাদের সবকিছু খুলে দেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। আমজনতার অর্থনীতি বুঝতে হবে। যেটি আমাদের দেশে অর্থনীতির জ্ঞান চর্চার মধ্যে তেমন নেই বললেই চলে।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট
মন্তব্য করুন