ঢাকা বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

চীনা সাম্রাজ্য ও মুসলিম দুনিয়া

আধিপত্য

চীনা সাম্রাজ্য ও মুসলিম দুনিয়া

.

ডেভিড পি গোল্ডম্যান

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৬:৫৮ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ১৩:১৫

ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ জাতিসংঘের রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা টের পায়, পুরো গ্লোবাল সাউথ পশ্চিমা প্রভাবের বাইরে চলে গেছে। এই বিষয়টি দ্বিতীয়বার তাদের সামনে আসে, যখন এই বছর অক্টোবর ২৭ তারিখে ১২০টি রাষ্ট্র জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গাজার পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিপক্ষে ভোট দেয়।        

এদিকে অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বিশ্বরাজনীতিতে চীনের প্রাধান্য বেড়েই চলেছে। চীনা নৌবহর আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে সাগরেও। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বাহিনী ও চিন্তকদেরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অথচ চীন কিন্তু খুব একটা উচ্চবাচ্য করছে না; কোমলভাবেই বিস্তার করছে ক্ষমতা ও প্রভাব। চীন এখন সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে মুসলিম দেশগুলোতে। 

চীনের আমেরিকায় রপ্তানির (মাসে ৪০ বিলিয়ন ডলার) কাছাকাছি পৌঁছে গেছে মুসলিম দেশগুলোতে রপ্তানির (মাসে ৩০ বিলিয়ন ডলার) পরিমাণ। গত পাঁচ বছরে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোসহ গ্লোবাল সাউথে চীনের বাণিজ্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে চীনের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এশিয়ার মধ্যে নতুন সিল্ক রোড চীনের এই বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রেখেছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোও এই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছে। আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর চীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সীমান্তের অর্থনৈতিক বিষয়-আশয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আর ভরসা রাখবে না সে। 

আমেরিকার উচিত প্রফেসর জ্যাং উইউইয়ের কথা মন দিয়ে শোনা। তিনি ৩ নভেম্বর অবজারভারকে বলেছেন, ‘বিশ্ব অনেক দিন ধরেই আমেরিকা-পরবর্তী যুগে প্রবেশ করেছে। তার মানে এই নয়, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমেরিকা এখনও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে পথের বাইরে চলে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে, দক্ষিণে অনেক বেশি উন্নয়ন, রসদ ও বিশাল বাজার রয়েছে।’  

তাঁর সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও জানান, আমরা চাই যুক্তরাষ্ট্র বদলে যাক, কিন্তু সেই প্রক্রিয়া সহজ নয়। চীনের সভ্যতা হাজার বছরের পুরোনো এবং সেই সভ্যতায় রয়েছে গভীর মনন ও প্রজ্ঞার ছাপ। আবার যখন আরবে আন্দোলন শুরু হয়, আমরা পশ্চিমকে পরামর্শ দিয়েছি ‘আরব বসন্ত’কে সমর্থন না জানাতে। কেননা, অচিরেই তা ‘আরব শীত’ হয়ে দেখা দিতে পারে। 

এই মুহূর্তে ইউরোপের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে শরণার্থী সংকট। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার নানা দেশের বিভিন্ন ভাঙনে শরণার্থীরা এসে জমা হচ্ছে ইউরোপে; ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। শান্তি ও উন্নয়ন ছাড়া এই সংকটের সমাধান হবে না। 

চীনের সভ্যতা বহুমাত্রিক। সেখানে রয়েছে দুই শতাধিক আঞ্চলিক ভাষা এবং ছয়টি প্রধান ভাষা। চীন ইউরোপের মতো ধর্মের ভিত্তিতে জনগণকে একমাত্রিক পরিচয়ে আবদ্ধ করেনি। চীন মধ্যপ্রাচ্যকে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য হিসেবেই দেখে। ফলে চীন চায় মধ্যপ্রাচ্য যে কোনো সমস্যা ও সংকট মোকাবিলা করে স্থিতিশীল থাকুক।  

চীনের প্রেসিডেন্ট জিনপিং মনে করেন, যা তিনি জার্মান চ্যান্সেলরের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন হোক আর ইউক্রেন সংকট হোক, সবার আগে বিবেচনা করতে হবে প্রতিরক্ষার বিষয়টি। প্রতিরক্ষানীতি হতে হবে এমন, যাতে তা হয় গঠনমূলক, উপযোগী ও স্থায়িত্বশীল। 

চীনের এই অবস্থান খুব সহজ-সরল, তাও বলা ঠিক হবে না। জিহাদিদের সঙ্গে চীন কী রকম ব্যবহার করে; নিজের সীমান্তে কী করে সে বিদ্রোহ দমন করে তারও দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রফেসর জ্যাং মনে করেন, চীন এই শরণার্থী সংকটে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত গাজার সংকট সমাধানে চীন সহায়ক হতে পারে।  

এর আগে ১৯৭৮ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট সাদাতকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গাজা সমস্যা সমাধানের জন্য এক প্রস্তাব দেন। মিসরের প্রতি গাজাকে অন্তর্ভুক্তির সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট সাদাত। পশ্চিমা কূটনীতিকরাও এই সমাধানের পথে হাঁটেননি। মিসর যথেষ্ট দরিদ্র; সেখানে জিহাদি সমস্যাও বিদ্যমান। হামাসের পূর্বসূরি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের ৪০ হাজার জিহাদি সেখানে কারাবন্দি। তার আর জিহাদি প্রয়োজন নেই।   

ইসরায়েল যদি হামাসকে বিলুপ্ত করতে পারে, গাজাকে অন্তর্ভুক্ত করা মিসরের জন্য হবে অর্থনৈতিক। সে ক্ষেত্রে চীন গালফ স্টেটগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে এই সমস্যা সমাধানে অগ্রণী হতে পারে। কেননা, চীনের ইতোমধ্যে মিসরের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও হাই-টেক নগরী নির্মাণে তার অবদান আছে। 

চীন যদি সত্যি সত্যি মধ্যপ্রাচ্য সংকটে নেতৃত্ব দেয়; মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়, তবে তা হবে এক কূটনৈতিক বিপ্লব।

ডেভিড পি গোল্ডম্যান: মার্কিন অর্থনৈতিক কৌশলবিদ, এশিয়া টাইমস থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ 
 

আরও পড়ুন