‘বাংলাদেশি’ অমর্ত্য সেনের ৯ দশক
শুভ জন্মদিন

নাভিদ সালেহ
নাভিদ সালেহ
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:০৩ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ১৩:০০
গত ৩ নভেম্বর ছিল অমর্ত্য সেনের ৯০তম জন্মদিন। অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের অন্তর্নিহিত কারণ অন্বেষণ করেছেন; সোশ্যাল চয়েস থিওরিতে কাজ করেছেন; অর্থনীতিতে নোবেল জয় করেছেন। অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ এবং হার্ভার্ডে। এসব তথ্য আমাদের জানা। তবে যা আমরা অনেকেই জানি না, এই মানুষটি কী করে অমর্ত্য সেন হলেন?
অমর্ত্য সেন জন্মসূত্রে ভারতীয় হলেও নিজেকে তিনি বাংলাদেশি বলেও দাবি করেন। তাঁর সত্তাজুড়ে যেমন রয়েছে শান্তিনিকেতন, তেমনি রয়েছে ঢাকা ও বাংলাদেশ। প্রফেসর সেনের বাবা আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক। তাঁর মা অমিতা সেন রবিঠাকুরের কাছের মানুষ। তিনি কবিগুরুর অধিকাংশ নৃত্যনাট্যের মূল চরিত্র চিত্রায়ণ করতেন। তাঁর নানা ক্ষিতিমোহন সেন শান্তিনিকেতনে সংস্কৃত আর মধ্যযুগীয় ভারতীয় সংস্কৃতি পড়াতেন ও কবিগুরুর বিশ্বভারতীর শিক্ষাক্রম তৈরির পুরোধা ছিলেন। সে কারণেই অমর্ত্য সেনের জন্মের সময় অমিতা সেন ঢাকা থেকে শান্তিনিকেতনের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন।
১৯৩৩ সালে জন্ম হয় অমর্ত্য সেনের। কবিগুরু প্রিয় ছাত্রী অমিতার পুত্রের নামকরণ করেন ‘অমর্ত্য’। জন্মের কিছুদিন পরই অমর্ত্য সেন আবার ঢাকা ফিরে আসেন। ৮ বছর বয়স অব্দি তিনি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। কলকাতা এবং ঢাকাতে এর রেশ স্পষ্ট। যুদ্ধের অস্থিরতা থেকে দূরে রাখতে তাঁর বাবা-মা তাঁকে ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করেন। মজার ব্যাপার হলো, অমর্ত্য সেনের ছাত্রজীবনের শুরুর দিকে শান্তিনিকেতনের বন্ধুরা তাঁকে ‘কইবো’ ডাকনামে ডাকত। কারণ তাঁকে তারা ‘বাঙাল’ বলে জানত। অমর্ত্য সেন তাঁর বাঙাল বা বাংলাদেশি পরিচয় দিয়েছেন গর্বের সঙ্গে। তিনি তাঁর গ্রন্থে এও প্রমাণ করেছেন– আদি বাংলা রাজ্য ঢাকা আর ফরিদপুরকে কেন্দ্র করে বিরাজ করত। পশ্চিমবঙ্গ অবস্থিত ছিল গৌড় রাজ্যে। তাই প্রকৃত অর্থে বাঙালি কারা– সে বিতর্কে জয় কাদের হতে পারে; প্রফেসর সেন ‘ঘটি আর বাঙাল’ বিতর্কে কার পক্ষ নেবেন, তা বলাই বাহুল্য। অমর্ত্য সেন রুই মাছের জায়গায় ভালোবাসতেন ইলিশ; ফুটবলে মোহনবাগানের স্থলে সমর্থন দিতেন ইস্ট বেঙ্গলকে; আর নদী নিয়ে কথা বলার সময় গঙ্গার জায়গায় পদ্মাকে নিয়ে গর্বিত হতেন। এই অনন্য গ্রন্থটিতে তিনি বাংলা ও ভারতবর্ষে ধর্মবিষয়ক বিভেদ নিয়ে তাঁর আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম ও সে সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। এই মহান বাঙালি যে কতটুকু বাংলাদেশি, তা জেনে অহংকার হয়েছে আমার।
অমর্ত্য সেনের দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছিল ছেলেবেলায়। তাঁর বয়স যখন ১০ তখন পঞ্চাশের মন্বন্তর তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার কারণে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি চালের দাম বাড়তে শুরু করে। এক বছরের মধ্যে দাম বেড়ে প্রায় পাঁচ গুণ হয়ে দাঁড়ায়, যা প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। শান্তিনিকেতনে অভুক্ত পথিকের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা মেলে অমর্ত্য সেনের, তখনই তিনি দুর্ভিক্ষের কারণ অন্বেষণ ও দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। সংকল্প করেন– এই মহামারি যেন আর কখনও না হয়, তার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান তাঁকে রাখতেই হবে। এই মন্বন্তরের কারণ খুঁজতে গিয়েই প্রফেসর সেন দেখান যে খাদ্যের জোগানের অভাব নয়, বরং খাদ্যমূল্যস্ফীতি এবং এতে প্রান্তিক মানুষের এনটাইটেলমেন্ট হারানোই দুর্ভিক্ষের কারণ। এটিই তাঁর সোশ্যাল চয়েস থিওরির মূল ভিত্তি।
প্রফেসর সেন তাঁর চিন্তা ও বিদ্যাতৃষ্ণায় কয়েকজন মহান মানুষের প্রভাবের কথা বলেছেন। মার্ক্সের চিন্তা তাঁকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। পাশাপাশি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের কথাও অমর্ত্য সেন উচ্চকণ্ঠে বলেছেন। মার্ক্সিস্ট মরিস ডব ও পিয়েরো স্রাফা এবং আন্তোনিও গ্রামসির সঙ্গে স্রাফার যোগাযোগ বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর গবেষণাক্ষেত্রকে। এ ছাড়া তিনি শিক্ষক ডেনিস রবার্টসনের প্রভাবের কথাও বলেছেন, যিনি ছিলেন কেন্সীয় অনর্থনীতিবিদ ও ‘লিকুইডিটি ট্র্যাপ’ তত্ত্বের প্রবক্তা। অমর্ত্য সেনের মননে গৌতম বুদ্ধ ও রবিঠাকুরের প্রভাবও স্পষ্ট। বুদ্ধের জাতিভেদে অনীহা ও রবিঠাকুরের বর্ণভেদের প্রতি অশ্রদ্ধা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাদের পাশাপাশি প্রফেসর সেন এক দল মেধাবী বন্ধুর কথাও তুলেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন আমাদের রেহমান সোবহান, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের জনক পাকিস্তানের মাহবুব উল হকসহ অসংখ্য বন্ধু। বন্ধুবৎসল এই মানুষটি যে অন্যের ভেতর প্রতিভা দেখতে পান; অন্যের সাফল্যে পুলকিত হয়ে ওঠেন, তা স্পষ্ট।
অমর্ত্য সেনের জীবন যে সংগ্রামবিহীন ছিল, তা একেবারেই নয়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভয়াবহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মুখের এই ক্যান্সার মোকাবিলায় এগিয়ে আসে সদ্য স্থাপিত চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার ইনস্টিটিউট। রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয় তাঁকে, যার ফলে ছিল ভয়ংকর ব্যথা, এমনকি মুখের আদল পর্যন্ত বদলে যাওয়া। এই ভয়াল রোগের সঙ্গে এখনও লড়ে চলেছেন তিনি। ব্যথা আর রোগের উপশম খুঁজেছেন বই আর জ্ঞান আহরণে।
এই মহান বাঙালির যে লুকোনো গুণটি আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো, তাঁর বিনয়। ৪০০ পাতার স্মৃতিচারণে একটিবারের জন্যও নিজের নোবেল বিজয়ের কথা বলেননি; বলেননি পুরস্কার ঘোষণার কথা; করেননি নোবেল গ্রহণের দিনটিতে তাঁর অনুভূতির চারণ। এমন বিনয় আজ আমাদের সমাজে বিরল। এই তর্কপ্রিয় বাঙালি, এই পদ্মাপ্রেমী বাংলাদেশি, এই ধর্মনিরপেক্ষ বিনয়ী আর সংগ্রামী মানুষটি আমাদের জন্য অনুকরণীয়। প্রফেসর সেন বিশ্বাস করেন, সমাজে যখন বৈষম্য থাকে, তখনই দরিদ্র আর অসহায়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। ধনী দেশে এ পক্ষপাত বাহুল্য মাত্র। শুভ জন্মদিন মর্ত্যের অমর্ত্য!
নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুর, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক