একাত্তরের এই দিনে
মওলানা ভাসানীর একাত্মতা

--
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১ | ১৪:৪৪
একাত্তরের ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সব সরকারি অফিস অচল হয়ে পড়ে। এদিন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা। ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মুহুর্মুহু মিছিল চলতে থাকে। ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিকেলে পল্টন ময়দানের জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে ঘোষণা করেন- ইয়াহিয়া সাহেব, অনেক হয়েছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। 'লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন' নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নাও। তিনি আরও বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোনো কিছু না করা হলে আমি মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন শুরু করব। ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উদ্দেশে বলেন, 'পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার নায়ক হওয়া অনেক বেশি গৌরবের। পল্টনে সেই বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা দৃঢ়কণ্ঠে আরও বলেন, 'অচিরেই পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবে।' তিনি সবাইকে বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা রাখতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'শেখ মুজিব আমার ছেলের মতো, সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না; বাঙালিরা মুজিবের ওপর আস্থা রাখেন, কারণ আমি তাকে ভালোভাবে চিনি।' এই দিন তিনি তার ভাষণের সঙ্গে ১৪ দফা দাবিও পেশ করেন।
এদিন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে পৃথক ও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র্র কায়েম করতে বদ্ধপরিকর।
আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়সহ সারাদেশে সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল সেসব চালু থাকে।
এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী। তিনি অসুস্থতার অজুহাত দিলেও এ অস্বীকৃতি প্রকারান্তরে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন বলে মনে করা হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকায় জাতিসংঘের উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দপ্তর পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম জার্মানি সরকারও তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত 'স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'-এর ছাত্রসভায় গৃহীত 'স্বাধীন বাংলাদেশ' ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করে। রাজশাহীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন নৈশ কারফিউ জারির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
সকালে পিআইএর বাঙালি কর্মচারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলে তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পূর্ব পাকিস্তান সফরের ঘোষণা দেওয়া হয় এই দিন। হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন জোরেশোরে পালনরত চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে অবাঙালিরা রেলওয়ে কলোনি এবং এ.কে. খান রোডে দুপুরের দিকে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিকেলে হালিশহর থেকে দেওয়ানহাট হয়ে আগ্রাবাদ পর্যন্ত অবাঙালিরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শোডাউন করে। পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছিল।
গ্রন্থনা :মাহফুজুর রহমান মানিক