জ্বালানি
বাপেক্স যেভাবে সাগরে গ্যাস তুলতে পারে
কল্লোল মোস্তফা
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০
আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশে 'সমুদ্র বিজয়' উৎসব পালিত হয়েছিল। তারপর দশক পেরিয়ে গেলেও জয় করা সমুদ্রসীমার গ্যাস ব্লকগুলো থেকে সুসংবাদ নেই। ওদিকে পার্শ্ববর্তী সমুদ্রাঞ্চলে মিয়ানমার বেশ কিছু গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করেছে। মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় যদি গ্যাস পাওয়া যায়, তাহলে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের ব্লকগুলোতে গ্যাস না পাওয়ার কারণ নেই! প্রয়োজন ছিল শুধু জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ।
বাংলাদেশের সাগর থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে না পারার পেছনে অনেক সময় বিদেশি কোম্পানির অনাগ্রহকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, উৎপাদন অংশীদারি বা পিএসসি চুক্তির আওতায় গ্যাস রপ্তানির সুযোগ না দিলে ও উত্তোলন করা গ্যাস বেশি দামে বিক্রির সুযোগ না দিলে বিদেশি কোম্পানি সাগরের গ্যাস উত্তোলনে আগ্রহী হয় না। ঠিক এ কারণেই গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে নিজস্ব অর্থায়নে বিভিন্ন বিদেশি ঠিকাদারি, প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা গেছে; একইভাবে বাপেক্সের কর্তৃত্বে বিদেশি কোম্পানি ভাড়া করে সাগরের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে উদ্যোগী হওয়া যেত। সমুদ্রসীমা মীমাংসার পরপরই কাজ শুরু করলে এতদিনে আমরা সাগরের গ্যাসের সুফল ভোগ করতে পারতাম।
গ্যাস উত্তোলন মডেল
তেল-গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি হতে পারে। যেমন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি বা পিএসসি পদ্ধতিতে কোম্পানি কস্ট রিকভারি হিসেবে বিনিয়োগের খরচ তুলে নেয়। বাকি লাভের গ্যাস চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। অন্যদিকে 'সার্ভিস কন্ট্রাক্ট' পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিভিন্ন কোম্পানির সেবা, প্রযুক্তি ভাড়া নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাতেই তেল-গ্যাস উত্তোলন করা হয়।
সত্তর-আশির দশক থেকেই তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো আউটসোর্সিং শুরু করে। প্রযুক্তির অভাবের কথা বলে বাংলাদেশে এ যাবৎ যেসব বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পিএসসি করা হয়েছে, তারাও বিদেশি ঠিকাদার দিয়েই কাজ করেছে। যেমন অগভীর সমুদ্রের ১৬ নম্বর গ্যাস ব্লকে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক বহুজাতিক সান্তোস 'অফশোর রিসল্যু' রিগটি ভাড়া করেছিল নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি সি-ড্রিলের কাছ থেকে। জনপ্রতিবাদ সত্ত্বেও যে কনোকো-ফিলিপসকে সাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক দেওয়া হয়েছিল, সেই কোম্পানিও কিন্তু রিগ ভাড়া নিয়ে কাজ করে। কাজেই বাপেক্সের পক্ষে স্থলভাগে গ্যাস উত্তোলনের দক্ষতা ব্যবহার করে, সার্ভিস কন্ট্রাক্ট পদ্ধতিতে রিগ ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করে, গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন তদারকি অসম্ভব বিষয় নয়।
দেশে দেশে সার্ভিস কন্ট্রাক্ট
জ্বালানি ও খনিজসম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে বিভিন্ন দেশে ক্রমেই সার্ভিস কন্ট্রাক্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশে দেশে পিএসসির বদলে সার্ভিস কন্ট্রাক্টের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। আশি ও নব্বই দশকের সন্ধিক্ষণ থেকে বড় বড় তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সার্ভিস কন্ট্রাক্টের আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে ভেনেজুয়েলা, কুয়েত, ইরান, ইরাক, মেক্সিকো, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, তুর্কমেনিস্তান ইত্যাদি দেশ।
নরওয়ের অভিজ্ঞতা
ষাটের দশকের শুরুতে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো যখন নরওয়েতে আসতে শুরু করে, দেশটি সে সময় তেল-গ্যাস উত্তোলনের কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাগত দিক সম্পর্কে কিছুই জানত না। বিদেশি কোম্পানি আকর্ষণে ব্যাপক করছাড় ঘোষণা করা হয়; রয়্যালটি ধরা হয় নামমাত্র। কিন্তু যখন দেখা যায়, প্রথম দফা চুক্তির আওতায় বিপুল তেল-গ্যাস পাওয়া গেলেও তাতে নরওয়ের অংশীদারি সামান্যই; তখন থেকেই তেল-গ্যাসক্ষেত্রে জাতীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি আলোচিত হতে থাকে। বহু লেখা, শ্বেতপত্র, সংসদীয় রিপোর্ট, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়- নরওয়ের সমুদ্রসীমার মধ্যে সংঘটিত কর্মকাণ্ডে জাতীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে গঠিত হয় নরওয়ের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি 'স্ট্যাটঅয়েল'।
প্রথমে স্ট্যাটঅয়েলকে নিজস্ব সক্ষমতায় তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অতি দ্রুত প্রযুক্তি স্থানান্তর করা হবে- এই শর্তে পরবর্তী সময়ে দ্রুত দক্ষতা অর্জনে যৌথ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। যেমন 'স্ট্যাটএফজর্ডফিল্ড' ব্লক বরাদ্দের বেলায় ৫০ শতাংশ মালিকানা রাখা হয় স্ট্যাটঅয়েলের; বাকি ৫০ শতাংশ মোবিল, এসা, শেল আই কনাকো প্রভৃতি কোম্পানির মধ্যে বণ্টন করা হয়। শর্ত থাকে, প্রথমে মোবিল অপারেটর হিসেবে কাজ করলেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে স্ট্যাটঅয়েলের হাতে নতুন তেল-গ্যাসক্ষেত্রটি পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে। ১৩ বছরের মাথায় বাস্তবিকই স্ট্যাটঅয়েল তেল-গ্যাসক্ষেত্রটি পরিচালনার দায়িত্ব বুঝে নেয়। এর তিন বছর পর সম্পূর্ণ নরওয়েজিয়ান মালিকানায় 'গালফ্যাকস' তেলক্ষেত্রটি আবিস্কার ও উত্তোলন শুরু করে।
বিনিয়োগের পুঁজি
অনেক সময় যুক্তি দেওয়া হয়, তেল-গ্যাস উত্তোলন কাজে 'বিপুল অর্থ' প্রয়োজন। তেল-গ্যাস পাওয়া না গেলে পুরো অর্থই নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। উৎপাদন অংশীদারি চুক্তিতে যেহেতু এই ঝুঁকিটা বিদেশি কোম্পানিই বহন করে, তাই বাংলাদেশের মতো 'দরিদ্র' দেশের পক্ষে বিদেশি কোম্পানিকে তার খরচের জন্য কস্ট রিকভারি গ্যাস এবং ঝুঁকির পুরস্কার হিসেবে প্রফিট গ্যাস দিয়ে হলেও এ ধরনের চুক্তি করা লাভজনক।
যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজে একবারেই সব অর্থ ব্যয় করে না কোম্পানিগুলো। প্রাথমিক অনুসন্ধান ও সিসমিক জরিপ করে দেখে, গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। জরিপে ইতিবাচক ফল মিললেই কেবল অনুসন্ধান কূপ খনন করে। অনুসন্ধান কূপ খননের আগ পর্যন্ত গ্যাস প্রাপ্তি ও পরিমাণ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায় না বলে কিছুটা ঝুঁকি থাকেই। কিন্তু খনিজসম্পদ অনুসন্ধান করতে হলে এইটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকি যে নেবে, প্রাপ্তি তারই হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স যদি এই ঝুঁকি না নেয়, তাহলে প্রাপ্তিটাও বাপেক্সের জুটবে না।
তেল-গ্যাস উত্তোলনে এই আর্থিক ঝুঁকিটুকু নেওয়া লাভজনক বলেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশে দেশে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির জন্য মুখিয়ে থাকে। এভাবে ঝুঁকি নেওয়া লাভজনক বলেই বাংলাদেশের মডেল পিএসসি ২০১২ সালের আওতায় ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসি অগভীর সমুদ্রের ৪ নম্বর ব্লকে ৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং ৯ নম্বর ব্লকে ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করে। বহুজাতিক কোম্পানি কিংবা বিদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যদি ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে নিজ দেশের গ্যাস সম্পদ উত্তোলনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কেন তা পারবে না?
বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার, তাতে গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবছর গড়ে কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগ তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অবশ্য বাংলাদেশকে তার অবকাঠামো উন্নয়ন করে গভীর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় করে তোলার জন্য গ্যাস ব্লকপ্রতি বিনিয়োগের বাইরে আরও কিছু অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে বাপেক্সের প্রকৌশলীদের ট্রেনিং, দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বাবদ। তবে এই বিনিয়োগ কেবল একটি-দুটি গ্যাস ব্লকের জন্য নয়; সাগরের অবশিষ্ট গ্যাস ব্লক, এমনকি প্রয়োজনে ভবিষ্যতে বিদেশি গ্যাসক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জনেও কাজে লাগবে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
২০১৬ সালের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানেও কিন্তু বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে :'প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত একদিন শেষ হয়ে যাবে। বাপেক্সের ভূমিকা পরিবর্তন করে একে দেশের বাইরের জ্বালানিসম্পদ অধিগ্রহণের অনুমোদন দিতে হবে যেন ভারতের ওএনজিসির মতো বাপেক্স ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে।' কাজেই স্থলভাগে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত নিঃশেষিত হওয়ার আগেই বাপেক্সকে সাগরের গ্যাস উত্তোলনে সক্ষম করে তোলা জরুরি।
কল্লোল মোস্তফা :লেখক, প্রকৌশলী, নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা
বাংলাদেশের সাগর থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে না পারার পেছনে অনেক সময় বিদেশি কোম্পানির অনাগ্রহকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, উৎপাদন অংশীদারি বা পিএসসি চুক্তির আওতায় গ্যাস রপ্তানির সুযোগ না দিলে ও উত্তোলন করা গ্যাস বেশি দামে বিক্রির সুযোগ না দিলে বিদেশি কোম্পানি সাগরের গ্যাস উত্তোলনে আগ্রহী হয় না। ঠিক এ কারণেই গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে নিজস্ব অর্থায়নে বিভিন্ন বিদেশি ঠিকাদারি, প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা গেছে; একইভাবে বাপেক্সের কর্তৃত্বে বিদেশি কোম্পানি ভাড়া করে সাগরের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে উদ্যোগী হওয়া যেত। সমুদ্রসীমা মীমাংসার পরপরই কাজ শুরু করলে এতদিনে আমরা সাগরের গ্যাসের সুফল ভোগ করতে পারতাম।
গ্যাস উত্তোলন মডেল
তেল-গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি হতে পারে। যেমন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি বা পিএসসি পদ্ধতিতে কোম্পানি কস্ট রিকভারি হিসেবে বিনিয়োগের খরচ তুলে নেয়। বাকি লাভের গ্যাস চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। অন্যদিকে 'সার্ভিস কন্ট্রাক্ট' পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিভিন্ন কোম্পানির সেবা, প্রযুক্তি ভাড়া নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাতেই তেল-গ্যাস উত্তোলন করা হয়।
সত্তর-আশির দশক থেকেই তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো আউটসোর্সিং শুরু করে। প্রযুক্তির অভাবের কথা বলে বাংলাদেশে এ যাবৎ যেসব বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পিএসসি করা হয়েছে, তারাও বিদেশি ঠিকাদার দিয়েই কাজ করেছে। যেমন অগভীর সমুদ্রের ১৬ নম্বর গ্যাস ব্লকে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক বহুজাতিক সান্তোস 'অফশোর রিসল্যু' রিগটি ভাড়া করেছিল নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি সি-ড্রিলের কাছ থেকে। জনপ্রতিবাদ সত্ত্বেও যে কনোকো-ফিলিপসকে সাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক দেওয়া হয়েছিল, সেই কোম্পানিও কিন্তু রিগ ভাড়া নিয়ে কাজ করে। কাজেই বাপেক্সের পক্ষে স্থলভাগে গ্যাস উত্তোলনের দক্ষতা ব্যবহার করে, সার্ভিস কন্ট্রাক্ট পদ্ধতিতে রিগ ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করে, গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন তদারকি অসম্ভব বিষয় নয়।
দেশে দেশে সার্ভিস কন্ট্রাক্ট
জ্বালানি ও খনিজসম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে বিভিন্ন দেশে ক্রমেই সার্ভিস কন্ট্রাক্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশে দেশে পিএসসির বদলে সার্ভিস কন্ট্রাক্টের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। আশি ও নব্বই দশকের সন্ধিক্ষণ থেকে বড় বড় তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সার্ভিস কন্ট্রাক্টের আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে ভেনেজুয়েলা, কুয়েত, ইরান, ইরাক, মেক্সিকো, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, তুর্কমেনিস্তান ইত্যাদি দেশ।
নরওয়ের অভিজ্ঞতা
ষাটের দশকের শুরুতে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো যখন নরওয়েতে আসতে শুরু করে, দেশটি সে সময় তেল-গ্যাস উত্তোলনের কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাগত দিক সম্পর্কে কিছুই জানত না। বিদেশি কোম্পানি আকর্ষণে ব্যাপক করছাড় ঘোষণা করা হয়; রয়্যালটি ধরা হয় নামমাত্র। কিন্তু যখন দেখা যায়, প্রথম দফা চুক্তির আওতায় বিপুল তেল-গ্যাস পাওয়া গেলেও তাতে নরওয়ের অংশীদারি সামান্যই; তখন থেকেই তেল-গ্যাসক্ষেত্রে জাতীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি আলোচিত হতে থাকে। বহু লেখা, শ্বেতপত্র, সংসদীয় রিপোর্ট, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হয়- নরওয়ের সমুদ্রসীমার মধ্যে সংঘটিত কর্মকাণ্ডে জাতীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে গঠিত হয় নরওয়ের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি 'স্ট্যাটঅয়েল'।
প্রথমে স্ট্যাটঅয়েলকে নিজস্ব সক্ষমতায় তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অতি দ্রুত প্রযুক্তি স্থানান্তর করা হবে- এই শর্তে পরবর্তী সময়ে দ্রুত দক্ষতা অর্জনে যৌথ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। যেমন 'স্ট্যাটএফজর্ডফিল্ড' ব্লক বরাদ্দের বেলায় ৫০ শতাংশ মালিকানা রাখা হয় স্ট্যাটঅয়েলের; বাকি ৫০ শতাংশ মোবিল, এসা, শেল আই কনাকো প্রভৃতি কোম্পানির মধ্যে বণ্টন করা হয়। শর্ত থাকে, প্রথমে মোবিল অপারেটর হিসেবে কাজ করলেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে স্ট্যাটঅয়েলের হাতে নতুন তেল-গ্যাসক্ষেত্রটি পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে। ১৩ বছরের মাথায় বাস্তবিকই স্ট্যাটঅয়েল তেল-গ্যাসক্ষেত্রটি পরিচালনার দায়িত্ব বুঝে নেয়। এর তিন বছর পর সম্পূর্ণ নরওয়েজিয়ান মালিকানায় 'গালফ্যাকস' তেলক্ষেত্রটি আবিস্কার ও উত্তোলন শুরু করে।
বিনিয়োগের পুঁজি
অনেক সময় যুক্তি দেওয়া হয়, তেল-গ্যাস উত্তোলন কাজে 'বিপুল অর্থ' প্রয়োজন। তেল-গ্যাস পাওয়া না গেলে পুরো অর্থই নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। উৎপাদন অংশীদারি চুক্তিতে যেহেতু এই ঝুঁকিটা বিদেশি কোম্পানিই বহন করে, তাই বাংলাদেশের মতো 'দরিদ্র' দেশের পক্ষে বিদেশি কোম্পানিকে তার খরচের জন্য কস্ট রিকভারি গ্যাস এবং ঝুঁকির পুরস্কার হিসেবে প্রফিট গ্যাস দিয়ে হলেও এ ধরনের চুক্তি করা লাভজনক।
যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজে একবারেই সব অর্থ ব্যয় করে না কোম্পানিগুলো। প্রাথমিক অনুসন্ধান ও সিসমিক জরিপ করে দেখে, গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। জরিপে ইতিবাচক ফল মিললেই কেবল অনুসন্ধান কূপ খনন করে। অনুসন্ধান কূপ খননের আগ পর্যন্ত গ্যাস প্রাপ্তি ও পরিমাণ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায় না বলে কিছুটা ঝুঁকি থাকেই। কিন্তু খনিজসম্পদ অনুসন্ধান করতে হলে এইটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকি যে নেবে, প্রাপ্তি তারই হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স যদি এই ঝুঁকি না নেয়, তাহলে প্রাপ্তিটাও বাপেক্সের জুটবে না।
তেল-গ্যাস উত্তোলনে এই আর্থিক ঝুঁকিটুকু নেওয়া লাভজনক বলেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশে দেশে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির জন্য মুখিয়ে থাকে। এভাবে ঝুঁকি নেওয়া লাভজনক বলেই বাংলাদেশের মডেল পিএসসি ২০১২ সালের আওতায় ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসি অগভীর সমুদ্রের ৪ নম্বর ব্লকে ৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং ৯ নম্বর ব্লকে ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করে। বহুজাতিক কোম্পানি কিংবা বিদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যদি ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে নিজ দেশের গ্যাস সম্পদ উত্তোলনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কেন তা পারবে না?
বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার, তাতে গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবছর গড়ে কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগ তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অবশ্য বাংলাদেশকে তার অবকাঠামো উন্নয়ন করে গভীর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় করে তোলার জন্য গ্যাস ব্লকপ্রতি বিনিয়োগের বাইরে আরও কিছু অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে বাপেক্সের প্রকৌশলীদের ট্রেনিং, দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বাবদ। তবে এই বিনিয়োগ কেবল একটি-দুটি গ্যাস ব্লকের জন্য নয়; সাগরের অবশিষ্ট গ্যাস ব্লক, এমনকি প্রয়োজনে ভবিষ্যতে বিদেশি গ্যাসক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জনেও কাজে লাগবে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
২০১৬ সালের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানেও কিন্তু বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে :'প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত একদিন শেষ হয়ে যাবে। বাপেক্সের ভূমিকা পরিবর্তন করে একে দেশের বাইরের জ্বালানিসম্পদ অধিগ্রহণের অনুমোদন দিতে হবে যেন ভারতের ওএনজিসির মতো বাপেক্স ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে।' কাজেই স্থলভাগে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত নিঃশেষিত হওয়ার আগেই বাপেক্সকে সাগরের গ্যাস উত্তোলনে সক্ষম করে তোলা জরুরি।
কল্লোল মোস্তফা :লেখক, প্রকৌশলী, নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা
- বিষয় :
- জ্বালানি
- বাপেক্স
- কল্লোল মোস্তফা