স্মরণ
পাঠকের হৃদয়ে আছেন সারওয়ার ভাই
গোলাম সারওয়ার (১ এপ্রিল ১৯৪৩ - ১৩ আগস্ট ২০১৮)
সবুজ ইউনুস
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২২ | ০৬:৪৮
আমি তখন বাংলার বাণী পত্রিকায় কাজ করি। বিএনপি আমলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের প্রতিবাদে মার্চ মাসে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জনতার মঞ্চ করা হয়। তৎকালীন ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এই মঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে আসছে হাজার হাজার মানুষ। সরকারি আমলারাও এসে যোগ দিচ্ছেন এই মঞ্চে। সে এক নজিরবিহীন সমাবেশ। প্রেস ক্লাব থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত শুধু মানুষ আর মানুষ। এটা ছিল আমার অ্যাসাইনমেন্ট। বেশ কিছুদিন এই কর্মসূচি অব্যাহত ছিল।
একদিন প্রেস ক্লাবের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জনতার মঞ্চের নেতাদের বক্তব্য নোট নিচ্ছি। শত শত সাংবাদিক। দাঁড়াবার জায়গা নেই বললেই চলে। বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি সারওয়ার ভাইও রিপোর্টারদের মতো নোট নিচ্ছেন। অনেকটা অবাক হলাম। সাধারণত এসব কর্মসূচি কভার করেন রিপোর্টাররা। সারওয়ার ভাই তখন ইত্তেফাকের ডাকসাইটে বার্তা সম্পাদক। ইত্তেফাক তখন সর্বোচ্চ প্রচারিত দৈনিক। অত্যন্ত প্রভাবশালী কাগজ। সাংবাদিকদের স্বপ্নের কর্মস্থল এই প্রতিষ্ঠানটি। গণমাধ্যমেও গোলাম সারওয়ার জনপ্রিয় একটি নাম। আপাদমস্তক এই সাংবাদিকের প্রতি সেদিনই শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে যায়। মনে বড় সাধ জাগে যদি সারওয়ার ভাইয়ের ইত্তেফাকে কাজের সুযোগ পেতাম!
যাই হোক, ইত্তেফাকে কাজের সুযোগ না হলেও পরে যুগান্তর ও সমকালে দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠানতুল্য এই সাংবাদিকের নেতৃত্বে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। একজন কর্মবীর সম্পাদকের চিফ রিপোর্টার ও বার্তা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছি। আমার পেশাগত জীবনের সোনালি সময়টা কেটেছে এই সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গেই। এভাবে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হবে তা ভাবিনি কখনও। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় সেই সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট ৭৫ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে পরলোকে চলে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সমকালের সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমি মনে করি, আধুনিক সংবাদপত্রের অন্যতম কারিগর ছিলেন শ্রদ্ধেয় সারওয়ার ভাই। দৈনিক সমকাল ও যুগান্তর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকেও প্রায় তিন দশক বার্তা সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন আধুনিক সাংবাদিকতার শিক্ষকও।
গোলাম সারওয়ার ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম গোলাম কুদ্দুস মোল্লা ও মা মরহুমা সিতারা বেগম। তিনি বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক।
দীর্ঘ দেড় দশক সারওয়ার ভাইয়ের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় কাজ করেছি। তাঁকে ঘিরে অসংখ্য স্মৃতি। এই স্বল্প পরিসরে এর কিছুই বলা সম্ভব নয়। তবুও দু-একটি বিষয় বলার চেষ্টা করি। সারওয়ার ভাইকে কখনও সাপ্তাহিক ছুটি নিতে দেখিনি। সকাল থেকে রাত দেড়টা-২টা পর্যন্ত টেবিলে বসে কাজ করতে দেখেছি। তিনিই একমাত্র সম্পাদক যাঁকে আমি অফিসে ঘুমাতে দেখেছি রাতের পর রাত। যুগান্তর অফিসে তাঁর ঘুমানোর জন্য আলাদা একটি কক্ষ ছিল। কর্মজীবনে আরও কয়েকটি পত্রিকায় আমি কাজ করেছি। কিন্তু সারওয়ার ভাইয়ের মতো এত পরিশ্রমী ও নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক দেখিনি। গভীর রাতে বাসায় গিয়ে তিনি সংবাদ চ্যানেল দেখতেন। বহু রাতে ফোন করে নতুন খবর দিতেন। এজন্য কাগজের নতুন সংস্করণ বের করতে হতো।
সারওয়ার ভাই আসলে সংবাদের সঙ্গেই সংসার করতেন। খবরই ছিল তাঁর নেশা। পাঠকের নাড়ি বুঝতেন দ্রুত। কোনো ঘটনার সংবাদমূল্য বুঝতে তিনি ভুল করতেন না। এজন্য দুটি দৈনিক কাগজ যুগান্তর ও সমকালকে দ্রুততম সময়ে পাঠকপ্রিয় করতে সক্ষম হন।
সারওয়ার ভাই স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন। সেখানে জনপ্রিয় নিউজ ওয়েবসাইটগুলো বুকমার্ক করা থাকত। তিনি যেখানে যে অবস্থায় থাকেন না কেন, ওয়েবসাইটে খবর পড়তেন। নিজেকে সারাক্ষণ আপডেট রাখতেন। একসঙ্গে গাড়িতে কোথাও যাওয়ার সময় আমি লক্ষ্য করতাম সারওয়ার ভাই মোবাইলে খবর পড়ছেন। গাড়িতে তখন বাজছে রবীন্দ্রসংগীত।
অধিকাংশ বড় কাগজেই প্রতিদিন সকালে প্ল্যানিং মিটিং হয়। সমকালেও প্রতিদিন সকালে বৈঠক হতো। সেখানে লক্ষ্য করতাম সর্বশেষ কোথায় কী ঘটনা ঘটেছে, তা সবই সারওয়ার ভাইয়ের জানা। তাঁকে নতুন কোনো খবর অবহিত করার সুযোগ থাকত না। বরং তাঁর কাছ থেকেই আপডেট নিতে হতো। প্রতিনিয়ত খবরের সঙ্গে থাকার কারণে সংবাদ পরিকল্পনা খুব ভালো হতো। এসব ক্ষেত্রে তাঁর মুনশিয়ানা সত্যিই অতুলনীয়।
সারওয়ার ভাইয়ের তিন ছেলেমেয়েই আমেরিকা প্রবাসী। এজন্য প্রায় প্রতি বছরই তিনি একবার আমেরিকা যেতেন সন্তানদের কাছে। আমেরিকা গেলে তিনি কমবেশি এক মাস থাকতেন। সুদূর আমেরিকা থেকে প্রতিদিন সংবাদ পরিকল্পনা সম্পর্কে নির্দেশনা দিতেন। একটি দিনও তিনি সংবাদ থেকে বিচ্যুত থাকতে পারতেন না। সাংবাদিকতা তাঁর রক্তে মিশে ছিল। সংবাদ ও সারওয়ার ভাইকে আলাদা করা সম্ভব ছিল না।
সারওয়ার ভাই ছিলেন ক্যান্সার বিজয়ী। ওপেন হার্ট সার্জারি ছিল। কিন্তু এই লোকটিকে কখনও অসুস্থ হতে দেখিনি। অসীম প্রাণশক্তি ছিল তাঁর। হালকা জ্বর-ঠান্ডাকে তিনি কখনও পাত্তা দিতেন না। একটি দিনও অফিস মিস করতেন না।
সারওয়ার ভাই ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সেদিনও তিনি সন্ধ্যা নাগাদ অফিসে ছিলেন। মিটিং করলেন। সম্ভবত সাড়ে ৭টার দিকে বললেন, সবুজ শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি বললাম, বাসায় যান, রেস্ট নেন। রাত ১২টায় খবর এলো, সারওয়ার ভাই ল্যাবএইডে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও কখনও হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখিনি। রাতেই হাসপাতালে দেখতে গেলাম আমরা কয়েকজন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। অক্সিজেন মাস্ক পরা ছিলেন। মাস্ক খুলে কথা বললেন অনায়াসে। খুব খারাপ কিছু মনে হয়নি। ভেবেছিলাম দু-এক দিনের মধ্যেই হয়তো আবার অফিসে আসবেন। কিন্তু এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ৪ আগস্ট নেওয়া হলো সিঙ্গাপুর। এরপর তিনি ফিরলেন। তবে নিষ্প্রাণ দেহ হয়ে।
সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব গোলাম সারওয়ার ষাটের দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন। সেই থেকে একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি এ পেশায় সৃজনশীল মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
গোলাম সারওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাবিতে ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। একই বছর দৈনিক সংবাদের সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংবাদে ছিলেন। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক মাস বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে সিনিয়র সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এরপর এখানেই প্রায় তিন দশক বার্তা সম্পাদক ছিলেন।
সবুজ ইউনুস, সহযোগী সম্পাদক ও অনলাইন ইনচার্জ, সমকাল
- বিষয় :
- স্মরণ
- সবুজ ইউনুস
- গোলাম সারওয়ার