শ্রদ্ধাঞ্জলি
মেজর পি কে ঘোষ: মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু

হারুন হাবীব
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৩ | ০৫:৩২
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পথচলায় হাতেগোনা কিছু মানুষ পাওয়া যাবে, যারা ভিনদেশি নাগরিক হয়েও আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। বিদেশি সেই বন্ধু অনেককেই বাংলাদেশ কৃতজ্ঞচিত্তে সম্মানিত করেছে ২০১২ সাল থেকে; কয়েক বছরে। তাদের দেওয়া হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’। কাজটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিদেশি বন্ধুদের সেই তালিকা পূর্ণাঙ্গ– এ কথা বলার সুযোগ নেই। যেমন ৬ জুলাই রাতে মেজর পি কে ঘোষের (পরিমল কুমার ঘোষ) প্রয়াণের খবর পেয়ে নতুন করে আক্ষেপ হলো। মনে হলো, তালিকা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্তরা আরও খোঁজখবর নিতে পারতেন। ত্রিপুরা সীমান্তে ১৯৭১ সালে দায়িত্বরত বিএসএফের তৎকালীন এই ক্যাপ্টেনও মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা পেতে পারতেন।
আমি নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছি চিরচেনা জনপদ জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ এলাকায়। সে কারণে ত্রিপুরা অঞ্চলে কর্মরত পি কে ঘোষকে জানার সুযোগ হয়নি তখন। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার গণমানুষের অসামান্য অবদানের তথ্য ও দলিলসংবলিত একটি গ্রন্থ রচনার কাজে ১৯৯০ সালে আগরতলায় গিয়ে মেজর ঘোষের কথা জানা হয়। তিনি তখন অন্য এলাকায় বদলি হয়েছেন বা অবসরে গেছেন। আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য এবং সাংবাদিক ও লেখক সুবীর ভৌমিক চেষ্টা করেও শ্রী ঘোষের সন্ধান দিতে পারেননি তখন। সেই আক্ষেপ দূর হয় বছর দুয়েক আগে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বিএসএফ ২০২১ সালে ‘বর্ডারম্যান’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক গ্রন্থ প্রকাশ করে। সেটিতে মেজর পি কে ঘোষের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ একটি নিবন্ধ স্থান পায়। তাঁর বয়স তখন ৮০ পেরিয়েছে; নয়াদিল্লি থাকেন। সুবীর কেবল লেখাটাই পাঠাননি আমাকে; একদিন হঠাৎ দিল্লি থেকে ফোন পেলাম মেজর পি কে ঘোষের। সে-ই প্রথম পরিচয়। তিনি নানা স্মৃতির কথা বললেন; ত্রিপুরা সীমান্তে পালাক্রমিক যুদ্ধে তাঁর অনেক বন্ধুর কথা জানতে চাইলেন।
নবগঠিত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সহায়তায় বিএসএফের সেদিনের এই তরুণ অফিসার ‘ক্যাপ্টেন আলী’ ছদ্মনামে যে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরুর পর দেশের প্রায় সব অঞ্চলে গড়ে ওঠে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে প্রাথমিক মুক্তিবাহিনী। নবগঠিত সেই মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে প্রাথমিকভাবে এগিয়ে আসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ত্রিপুরা সীমান্তেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ক্যাপ্টেন ঘোষ তখন ছিলেন ত্রিপুরার শ্রীনগর, আমলিঘাট, সমারেন্দ্রগঞ্জ ও নালুয়া বর্ডারে দায়িত্বরত বিএসএফের ‘এফ’ কোম্পানির কমান্ডিং অফিসার।
আমার সঙ্গে বছর দুয়েকের যোগাযোগে বয়োবৃদ্ধ ভারতীয় এই সেনা কর্মকর্তা বহুবিধ স্মৃতিচারণ করেছেন। প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য এ রকম– ২৬ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে একজন ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে একটি পাকিস্তানি পদাতিক দল সাব্রুমের দিকে এগিয়ে শোভাপুর ব্রিজের দিকে আসতে থাকে। ব্রিজটি ছিল যুদ্ধের কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অগ্রসরমান পাকিস্তানি সৈন্যরা এলাকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নির্যাতন চালাতে থাকে। উপস্থিত ইপিআর বাঙালি জোয়ানদের সীমিত শক্তিতে তাদের রোখা সম্ভব ছিল না। ফলে স্থানীয় ইপিআরের হাবিলদার নুরুদ্দিন সীমান্ত পেরিয়ে স্থানীয় বিএসএফ কমান্ডার ক্যাপ্টেন পি কে ঘোষের সঙ্গে দেখা করেন। সঙ্গে আসেন স্থানীয় এমএনএ অধ্যাপক ওবায়দুল্লাহ মজুমদার ও আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আমির হোসেন। তারা ক্যাপ্টেন ঘোষের কাছে সাহায্য চান। কিন্তু তিনি ত্বরিত সিদ্ধান্ত দিতে রাজি হননি। কারণ আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করতে হলে ওপরের অনুমতি প্রয়োজন।
ওদিকে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও হাবিলদার নুরুদ্দিন ক্রমাগত মানবিক চাপ দিতে থাকেন। এরই মধ্যে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে কয়েকশ মানুষ ইপিআর দলটির সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকলে তারা পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগানের গুলির মুখে পড়ে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। ক্যাপ্টেন ঘোষ পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করেন। ইপিআরের ছয় জওয়ানকে নিয়ে হাবিলদার নুরুদ্দিনের নেতৃত্বে একটি ছোট বাহিনী তৈরি করা হয়। নবীন মুক্তিবাহিনী শপথ গ্রহণ করে। দুটি দলে ভাগ হয়ে ইপিআরের দলটি শোভাপুর ব্রিজের দুই পাশে অবস্থান নেয়, যাতে পানি পেরিয়ে এবং খুবই কম গুলি চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের অগ্রসর হওয়া বন্ধ করা যায়। কেবল কৌশলগত পরামর্শই নয়; ক্যাপ্টেন ঘোষ সবকিছু তুচ্ছ করে সেদিন সীমান্ত পেরিয়ে যুদ্ধাঞ্চলে ঢুকে পড়েন।
এর পর নবগঠিত মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। এক সময় তারা অবরুদ্ধ হয়। রসদ ও খাবার ফুরিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্য দলটি পরাজিত হয়; কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করে; বাকিরা পালিয়ে যায়। এর পর হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে নবীন মুক্তিবাহিনী শোভাপুর ব্রিজে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। এলাকা মুখরিত হয় জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে।
এ ঘটনায় ক্যাপ্টেন ঘোষ তাঁর সিনিয়রের প্রবল রোষানলে পড়েন। তাঁকে কোর্ট মার্শাল করার চেষ্টা চলে। কারণ, বিনা অনুমতিতে তিনি আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। ‘বর্ডারম্যান’ গ্রন্থে প্রকাশিত নিবন্ধে পি কে ঘোষ লিখেছেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমি অসহায় বোধ করলেও ভাবি, অস্ত্রহীন নিরপরাধ মানুষের ওপর পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি কোনো অন্যায় করিনি।’
শোভাপুর ব্রিজে ২৭-২৮ মার্চের যুদ্ধটি ছিল নবগঠিত মুক্তিবাহিনীর প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং বিজয়। অবশ্য পূর্ণ শক্তিতে পরে নতুন আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা শোভাপুর ব্রিজ দখল করে। এ ব্রিজ দখলকে কেন্দ্র করে আবারও প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের পূর্ণাঙ্গ মুক্তিবাহিনী সেটি নতুন করে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
মেজর ঘোষের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে আমি ফোন করি। যিনি ধরলেন তিনি তাঁর কন্যা আগমনী ঘোষ। পিতাকে দিল্লির গ্রিন পার্কে দাহ করার কথা জানিয়ে আগমনী অনুরোধ করলেন, আমি যেন শেষকৃত্যের খবরটি সবাইকে জানিয়ে দিই।
মহান মুক্তিযুদ্ধের এই অকৃত্রিম ভারতীয় বন্ধুর শেষ ইচ্ছা ছিল– টাঙ্গাইলে তাঁর পিতৃপুরুষের মাটিতে একবার আসবেন, ঘুরে যাবেন। সেটি আর হওয়ার নয়। তাঁর স্মৃতির প্রতি অশেষ প্রণতি।
হারুন হাবীব: বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক
- বিষয় :
- শ্রদ্ধাঞ্জলি
- হারুন হাবীব