ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

শরণার্থী

রোহিঙ্গা শিবিরে সহিংসতা আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকি

রোহিঙ্গা শিবিরে সহিংসতা আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকি

দেলোয়ার হোসেন

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৩ | ০৫:৩২

সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো অনেক বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সশস্ত্র হামলার যেসব ঘটনা আমরা দেখছি, সেগুলো নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, সর্বশেষ শুক্রবার উখিয়ার বালুখালীর রোহিঙ্গা শিবিরে দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া পৃথক ঘটনায় ছুরিকাঘাতে আরও এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়। এভাবে রোহিঙ্গা শিবিরে গত ছয় মাসে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে অর্ধশতাধিক হত্যার ঘটনা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। বস্তুত বাংলাদেশ আগে থেকেই বিশ্বের কাছে এ শঙ্কার কথা বলে আসছে– রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো বিষয়টি বরাবর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে উখিয়ায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলো আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি। এগুলো মিয়ানমারের নিকটবর্তী। আমরা জানি, সীমান্তবর্তী কোনো সংকটই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সেটিই বলে। এগুলো দেশীয়, আঞ্চলিক এমনকি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় এসব খুনোখুনি হচ্ছে। কারণ ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে রাখলে অপহরণ ও মাদক বাণিজ্যে তাদের সুবিধা হয়। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অর্থের মূল উৎস মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে মাদক পাচারের ব্যবসা।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় স্বল্প সময়ের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায়। আমরা ভেবেছিলাম, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে। প্রথম দিকে যেভাবে অন্তর্জাতিক সাহায্য ও বিভিন্ন দেশের তৎপরতাদেখেছি, ধীরে ধীরে তা অনেকটাই কমে আসে। এমনকি যে মিয়ানমার তাদের জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা ও নিপীড়ন চালিয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে, সেই দেশটিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণ করেনি। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের তৈরি এবং মিয়ানমারকেই এর সমাধান করতে হবে।

মিয়ানমার পরিস্থিতি পরে অন্যদিকে মোড় নেয়। সেখানে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সেখানকার মানুষ বিক্ষোভ করে। মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার যখন অভ্যন্তরীণভাবে সমস্যার মধ্যে রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান তাদের অগ্রাধিকারে থাকার কথা নয়। সে জন্য বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় যে অস্থিতিশীলতা বিরাজমান, সেখানেও তাদের হাত থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা বিষয়টি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারলে তাদেরই লাভ।

সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর যে তৎপরতা সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি, তা এমন সময়ে ঘটছে যখন বলা চলে গোটা অঞ্চলই অস্থিতিশীল। একদিকে বান্দরবানে কেএনএফ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা; অন্যদিকে ভারতের মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা এবং মিয়নমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সশন্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘর্ষ– পুরো অঞ্চলে সংঘাতের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের সংঘাত বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ সামান্যই। এ পরিস্থিতি আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট তৈরি করতে পারে। সে জন্যই রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান জরুরি। এভাবে সময় যত বাড়বে, পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠতে পারে। মনে রাখতে হবে, দুই বছর আগেও পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল না। এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীর যে খুনোখুনি দেখা যাচ্ছে; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হলে এতদিনে হয়তো ভিন্ন চিত্র দেখা যেত।

ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের কক্সবাজার কিংবা বান্দরবান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার পেছনে বিভিন্ন পক্ষের মদদ থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে সজাগ ও সচেতন। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির প্রসিকিউটর। রোহিঙ্গাসংশ্লিষ্ট মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে তাঁকে অনুরোধ জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমরা প্রত্যাশা করি, এ বিচারকাজ দ্রুত হবে।

এটা স্বীকার করতেই হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রোহিঙ্গা বিষয়ে তৎপরতা বর্তমানে কমেছে। গত বছর শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ একটা কারণ নিঃসন্দেহে। এখন ইউক্রেন যেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে; রোহিঙ্গা বিষয়টি সেভাবে পাচ্ছে না। এমনকি ফিলিস্তিনিদের যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে; ফিলিস্তিনের মানুষ তাদের ভূখণ্ড হারাচ্ছে; সেখানেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরব নয়। ফিলিস্তিনি কিংবা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যে ধরনের বৈষম্য আমরা দেখছি, তা দুঃখজনক।

তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের উদ্যোগে প্রত্যাবাসনে আমরা আশার আলো দেখছিলাম। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এ অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন সেভাবে আসছে না, জাতিসংঘ যেখানে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চরমভাবে ব্যর্থ, এমনকি পশ্চিমা বিশ্ব এখন মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যেও যুক্ত হচ্ছে– এ অবস্থায় চীনা উদ্যোগের বিরোধিতা কেন?

রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থিতিশীল রাখা কিংবা রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে সশস্ত্র তৎপরতা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশের আশ্রয়ে যেহেতু তারা রয়েছে, সেহেতু আমাদের মাথাব্যথা বেশি। বিশেষ করে স্থানীয় যে জনসাধারণ রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল, সেখানকার পরিস্থিতির কারণে তারাও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করায় তাদের কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই। জাতিসংঘসহ তাদের নির্লিপ্ততা পরিস্থিতিকে আরও সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশের তাগিদ আমলে নিয়ে বিষয়টি তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র তৎপরতার পেছনে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নাম আসছে। এর পেছনে নাম না জানা আরও গোষ্ঠীর উপস্থিতি অস্বাভাবিক নয়। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তাদের বিপজ্জনক খেলা সাধারণভাবে দেখা এবং এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে জিইয়ে রাখা এ অঞ্চলের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিশেষ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা যেহেতু গোটা অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে, সেহেতু রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এ মুহূর্তে জরুরি। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে চীন ও ভারতের ভূমিকাও এখানে যথাযথ গুরুত্বের দাবিদার। তাদের পক্ষ থেকে নেওয়া উদ্যোগ ফলপ্রসূ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের আহ্বানে বিশ্বের সাড়া দেওয়ার মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব।

ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত

আরও পড়ুন

×