ঢাকা শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রজাপতি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃদেশীয় সীমান্ত এলাকা

প্রজাপতি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃদেশীয় সীমান্ত এলাকা

বিপন্ন প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মেলে আন্তঃদেশীয় সীমান্ত এলাকায়

আশিকুর রহমান সমী

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৬:৫৫

মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি, ফড়িং, পাখি কিংবা বনের বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে না। তাদের নেই কোনো সীমানা। ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে পারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু দেশগুলোর তো রয়েছে ভৌগোলিক সীমারেখা। আর দুই দেশ যেখানে মিলিত হয় সেখানে থাকে আন্তঃদেশীয় সীমানা। গবেষণায় দেখা যায়, এই আন্তঃদেশীয় সীমানাগুলো বন্যপ্রাণী তথা জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্র্যর ৫৭ শতাংশের খোঁজ পাওয়া যায় এসব এলাকায়।

মানুষের চলাচল কিংবা মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড কম থাকায় আন্তঃদেশীয় সীমান্তে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এই পরিবেশের গুণগত মান জীব জগতের আবাসস্থল হিসেবে খুবই অনুকূল। তাই সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা তুলনামূলক বেশি। এছাড়া এখানে রয়েছে স্থানীয় লতাগুল্ম, বৃক্ষে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। সব মিলে তৈরি হয়েছে সমৃদ্ধ এক প্রতিবেশ ব্যবস্থা। যার ফলে বিপন্ন বা বিরল প্রজাতির প্রাণীর দেখা মেলে এই এলাকাগুলোতে। তাই এই আন্তঃদেশীয় সীমানা এলাকা জীব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।

আয়তনে ছোট হলেও আমাদের বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র্যের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ। ইন্দোচায়না এবং ইন্দোবার্মা জীব বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলের মিলন স্থলে অবস্থানের কারণে রয়েছে প্রাণী বৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। বাংলাদেশের তিন দিকই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমানা বেষ্টিত। দক্ষিণ পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের স্থল সীমান্তরেখার দৈর্ঘ্য ৪,২৪৬ কিলোমিটার যার ৯৪ শতাংশ (৪,০৫৩ কিলোমিটার) ভারতের সঙ্গে এবং বাকি ৬ শতাংশ (১৯৩ কিলোমিটার) মিয়ানমারের সঙ্গে। এই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো ঘিরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরায় রয়েছে অসংখ্য সংরক্ষিত এলাকা। এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে পুরো সীমানাই পাহাড়ি বনে আচ্ছাদিত। যার ফলে প্রাণীরা এসব এলাকাকে কেন্দ্র করে বিচরণ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও। আর এর মধ্যে প্রজাপতি অন্যতম।

প্রজাপতি এমন এক ধরনের পতঙ্গ, যা লেপিডোপটেরা বর্গের অন্তর্ভুক্ত। তাদের রয়েছে মনোমুগ্ধকর রং ও পাখা। প্রকৃতিতে প্রজাপতির গুরুত্ব অপরিসীম। পরাগায়ন থেকে শুরু করে খাদ্য শৃঙ্খলে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কবিতা-সাহিত্য থেকে ইকো-ট্যুরিজম সবখানেই এদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামক (উপাদান) যেমন তাপমাত্রা, আদ্রতা, মাটির গুণাগুণ, আলোক তীব্রতা, উদ্ভিদের উপস্থিতির সামন্যতম পরিবর্তনের ওপরও তারা সংবেদনশীল।

বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রাপ্ত প্রজাপতির সংখ্যা ১৮ হাজারেরও বেশি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। প্রখ্যাত প্রাণিবিদ ও প্রজাপতি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন তুহিনের প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই প্রজাতিগত সংখ্যাটি ৪২০টিরও বেশি। আইইউসিএনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে লাল তালিকাভুক্ত প্রজাপতির সংখ্যা ৩০৫টি। ২০১৫ সালের তথ্যমতে, দেশের এই  প্রজাপতিদের মধ্যে একটি প্রজাতি মহাবিপন্ন, ১১২টি প্রজাতি বিপন্ন, ৭৫টি প্রজাতি সংকটাপন্ন, ৩২টি প্রজাতির সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেই এবং বাকিগুলো বিলুপ্তির ঝুঁকির আশঙ্কামুক্ত। তারমানে দেশের ৬২ শতাংশ প্রজাপতি ঝুঁকির তালিকায়।

একমাত্র মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রজাপতিটির দেখা মিলে সুন্দরবনে। সুন্দরবন বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃদেশীয় সীমানায় অবস্থিত এবং পৃথিবীর সব চেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো প্রাণীর বসবাস। প্রতিবেশ ব্যবস্থার কারণেই সুন্দরবনে পাওয়া যায় ‘সুন্দরবন ক্রো’ নামে প্রজাপতিটি।

বিপন্ন ১১২টি প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে ৯৮টির দেখা মেলে সিলেট ও চট্টগ্রামের আন্তঃদেশীয় সীমান্ত এলাকায়। আর সংকটাপন্ন প্রজাতির ৭৩টির দেখা মেলে। বাংলাদেশের বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রায় প্রতিটি প্রজাতির দেখা মেলে এই আন্তঃদেশীয় সীমানা এলাকায়। আর এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি বনের আন্তঃদেশীয় সীমানার প্রজাপতিরা অন্যতম। পাশাপাশি রাজশাহী অঞ্চলও এখানে অন্যতম।

সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি বনাঞ্চল ইন্দোবার্মা হটস্পটে অবস্থিত। যার ফলে এখানে রয়েছে অসংখ্য বুনো উদ্ভিদ, যারা পোষক বৃক্ষ হিসেবে কাজ করে প্রজাপতির। এই বৃক্ষ, তরু, গুল্মলতা আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তাই প্রজাতিগত বৈচিত্র্য এখানে অনেক বেশি।  আন্তঃদেশীয় সীমানা নতুন প্রজাপতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবেও বিবেচিত। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দেশের উত্তর-পূর্বের আন্তঃদেশীয় সীমানার বনভূমি, বিশেষ করে রাজকান্দী সংরক্ষিত বন নতুন প্রজাপতি পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশে গত পাঁচ বছরে ১৪টি নতুন প্রজাতির সবগুলো প্রজাপতিই আন্তঃদেশীয় সীমান্ত এলাকা থেকে পাওয়া।

ছড়া, ঝিরি, প্রকৃতিক বন, বনের তরুলতা প্রজাপতির আবাসস্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যার ফলে এই বন প্রজাপতির সমৃদ্ধ আবাসস্থল। পাশাপাশি এসব বন সীমান্তবর্তী এবং যাতায়াত দুরূহ হওয়ায় জীব বৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞরা বিস্তৃতভাবে এসব এলাকায় অনুসন্ধান চালাতে পারেননি।

তবে যেহেতু আন্তঃ সীমানা এলাকার বনে পাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু আরও একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, এসব এলাকায় আগে এই প্রজাতির আরও বিস্তৃতি ছিল, যা মানবসৃষ্ট কারণে আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। এর ফলে কালে ভদ্রে এর দেখা মিলছে। অনেক ক্ষেত্রে একবারের পর আর কোনো হদিস মিলছে না। তবে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা বেশির ভাগ প্রজাপতির বড় একটি অংশের দেখা এখনও পাওয়া যায় আন্তঃদেশীয় সীমানায়।

বিশ্বব্যাপী ট্রান্সবাউন্ডারি কনজারভেশন বা আন্তঃসীমান্ত সংরক্ষণ শব্দ বন্ধনী জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে বিষয়গুলো নতুন হলেও আমাদের ভাববার সময় চলে এসেছে এই আন্তঃদেশীয় সীমানার জীববৈচিত্র্য নিয়ে। আর এ ক্ষেত্রে প্রজাপতিরা এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এসব এলাকায় প্রয়োজন প্রজাপতি সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। গণমানুষের মধ্যে সচেতনতার প্রসার ঘটাতে হবে। তা না হলে আমরা খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলব প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্যকে।

লেখক: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, গবেষক

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×