ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম

ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম

প্রথমে ব্যাট তৈরি বিন্নি গ্রাম থেকে শুরু হলেও এখন আশপাশের ১৫টি গ্রামে তৈরি হচ্ছে

 রুবেল নাহিদ

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২০

পিরোজপুরের নেছারাবাদের একটি গ্রাম বিন্না; অজপাড়াগাঁ হিসেবেই জানতেন সবাই। তবে গ্রামটিকে এখন সবাই চেনেন ‘ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম’ হিসেবে। পিরোজপুর সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের অবহেলিত এ জনপদে আধুনিকতার তেমন ছোঁয়া পড়েনি এখনও। তবুও বসে নেই এ গ্রামের নারী-পুরুষ। ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে হাজারো কারিগরের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এ নেছারাবাদ উপজেলায়। এখানকার ক্রিকেট ব্যাট যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
কয়েক যুগ ধরেই কাঠ ব্যবসা সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নেছারাবাদের ইন্দেরহাটসহ বিন্না, জিলবাড়ি, চামি, ডুবি, উড়িবুনিয়া, বলদিয়াসহ অন্তত আরও ১৫টি গ্রাম। পরবর্তী সময়ে এসব গ্রামেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। বর্তমানে কারখানার সংখ্যা শতাধিক। জানা গেছে, দেশে যে হাজার হাজার ব্যাটের ব্যবহার হয় এর মূল কারিগর নেছারাবাদের বেলুয়া নদীর তীরে অবস্থিত উড়িবুনিয়ার সুতার পরিবারে জন্ম নেওয়া মৃত আব্দুল লতিফ মিয়া।
এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। প্রতিদিন এসব গ্রাম থেকে শত শত ব্যাট তৈরি করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। উন্নত মানের ক্রিকেট ব্যাট যাচ্ছে বিদেশেও।
বিন্না গ্রামে ব্যাট তৈরিতে জড়িত স্থানীয়রা জানান, ব্যাট তৈরির জন্য আমড়া, কদম, গাউয়া, নিমশিশু, তুলা, ডুমুর আর ছাতিম গাছ ব্যবহার করা হয়। এ গাছগুলো স্থানীয় কৃষক পরিবার থেকে কেনা হয়। কারিগররা সাতটি স্তরের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাট তৈরি করেন। প্রথমে একটি গাছ সমিলে নিয়ে মূল অংশ তৈরি করা হয়। তারপর তাতে লাগানো হয় হাতল। এরপর ব্যাটের কাঠামো তৈরি হয় ফিনিশিংয়ের মাধ্যমে। এই ফিনিশিং প্রক্রিয়া আধুনিক না হওয়ার কারণে সময় লাগে একটু বেশি। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে একটি ব্যাট তৈরিতে ১৫-২০ দিন সময় লাগে। এসব ব্যাটের জন্য স্টিকার কেনা হয় ঢাকা থেকে। নেছারাবাদে তৈরি ব্যাট ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। বাংলাদেশে দুই ধরনের ক্রিকেট ব্যাট ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক মানের ব্যাট আসে পাকিস্তান থেকে। দেশীয় ব্যাটের বড় অংশ উৎপাদিত হয় পিরোজপুরে। এর বাইরে যশোর ও ঝিনাইদহে ব্যাট তৈরি হয়।
কারিগর রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার চাইলে এবং সহায়তা করলে আমরা আন্তর্জাতিক মানের ব্যাট তৈরি করতে পারব; যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে।’
বিন্না গ্রামের লোকজন জানান, প্রথমে ব্যাট তৈরি এই গ্রাম থেকে শুরু হলেও পরে আশপাশের ইন্দেরহাট, ঝিলবাড়ি, চামি, ডুবি, কুড়িবুনিয়া, পঞ্চবুটি, আউরবুনিয়াসহ প্রায় ১৫টি গ্রামে তৈরি হচ্ছে।
শহিদুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক জানান, তিনি ব্যাটের হ্যান্ডল তৈরি করেন। হাজারে ৭০০ টাকা দেওয়া হয় তাকে, দিনে এক হাজার হ্যান্ডল তৈরি করতে পারেন। তিনি আরও জানান, এক দিনে একজনে পাঁচটি ব্যাট তৈরি করতে পারেন। 
আকতার নামের এক কারখানা মালিক বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের ব্যবসার অবস্থা খারাপ। নগদ টাকায় কাঠ কিনে ব্যাট তৈরি করে বাকিতে বিক্রি করি ঢাকায়। টাকা অনেক দিন পরে দেয়।’
ব্যাটে স্টিকার বসান মো. আহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ব্যাটের স্টিকার ঢাকা থেকে কিনে আনতে হয়। দামি ব্যাটের স্টিকার কিনতে সেটসহ প্রতি ব্যাটে ১৫ টাকা খরচ হয়। কম দামি ব্যাটের স্টিকার সেটসহ ৩ থেকে ৫ টাকায় কিনতে হয়। স্টিকার লাগানোর পর ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেগুলো পাইকারি দামে বিক্রি হয়।’
নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘নেছারাবাদের বিন্না গ্রামের ব্যাটশিল্প রক্ষার্থে সরকারি যেকোনো সহযোগিতার প্রয়োজনে আমরা শিল্পীদের পাশে আছি। এ ব্যবসার প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। এ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রণোদনা পেলে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের পৌঁছে দেওয়া হবে।’ v

আরও পড়ুন

×