ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

উচ্চ আদালত

বিচারক নিয়োগ ও পদায়ন এবং সংবিধান সংশোধন

বিচারক নিয়োগ ও পদায়ন এবং সংবিধান সংশোধন

ফাইল ছবি

মো. শরিফুল হক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৯

বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা জনগণের কাঙ্ক্ষিত বিষয়। কারণ, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য এর বিকল্প নেই। বর্তমানে বিচার বিভাগ আর্থিক বিষয়ে এবং উচ্চ ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও পদায়নে প্রধানমন্ত্রী তথা নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল; যা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। 

যদিও সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফায় উল্লেখ রয়েছে যে, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করবেন। কিন্তু সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় উল্লেখ রয়েছে, এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করবেন। অর্থাৎ ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করবেন। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া অন্যান্য বিচারককে অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি ছাড়া বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারককে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নিয়োগ প্রদান করবেন। পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারককে নিয়োগের বিধান থাকায় ওই বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর তথা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক নিয়োগের আশঙ্কা থেকে যায়; যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। 

আবার সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের ২ দফা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হলে এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্যূন ১০ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট থেকে থাকলে, অথবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বৎসর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান করে থাকলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন। এমতাবস্থায় যদি ওই যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো অ্যাডভোকেট কিংবা বিচার বিভাগীয় কোনো কর্মকর্তা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে চান এবং ওই ব্যক্তি যদি তাঁর দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে যায় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকেন, অর্থাৎ ওই ব্যক্তি যদি স্বাধীনভাবে তাঁর বিচারিক দায়িত্ব কিংবা অন্য কোনো অর্পিত দায়িত্ব পালনে দ্বিধাগ্রস্ত হন তাহলে এটিকে বিদ্যমান উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি উপজাত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ দফা অনুযায়ী ওই বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয় প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়েছে; যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধকতা। এ অবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারকদের নিয়োগ ও তাদের স্থায়ীকরণ, আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফা, ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফা এবং ৯৮ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনতে হবে।

সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া অন্যান্য কাজ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফা অনুযায়ী অন্যান্য বিচারক নিয়োগ, ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে অতিরিক্ত বিচারক ও আপিল বিভাগের অস্থায়ী মেয়াদের জন্য বিচারক নিয়োগের বিষয় সংযোগ করতে হবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক ও আপিল বিভাগে অস্থায়ী মেয়াদের জন্য বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজন নেই মর্মে বিধান করতে হবে। এতে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকের নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী তথা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কমে যাবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথ সুগম হবে। 

একইভাবে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, প্রধান  বিচারপতিকে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু প্রধান বিচারপতি হওয়ার জন্য কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। এ কারণে প্রধান  বিচারপতিকেও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগদানের সুযোগ থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কর্মে প্রবীণতম বিচারক প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হতে পারেন। তবে প্রবীণতম বিচারক অসুস্থতার বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান, তবে তাঁর পরবর্তী প্রবীণতম বিচারক এবং তিনিও অস্বীকৃতি জানালে তাঁর পরবর্তী প্রবীণতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি। এ পদ্ধতিতে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হলে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আশঙ্কা থাকবে না। 

আবার ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফায় আরও উল্লেখ রয়েছে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করবেন। যেহেতু বিচারক নিয়োগের কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই এবং যোগ্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ড নেই, সেহেতু অনেক সময় যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ নাও পেতে পারেন। এ অবস্থায় ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফা অনুসারে যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ও অন্যান্য বিচারকের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিটি আইন নির্ধারিত পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করে যে নাম সুপারিশ করবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁকে বা তাদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তবে কমিটির সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের কারও বিষয়ে রাষ্ট্রপতি অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন বোধ করলে, পুনরায় যাচাই-
বাছাই ও সুপারিশের জন্য কমিটির কাছে পাঠাতে পারেন।

সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিভাগের জন্য যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত এবং হাইকোর্ট বিভাগের কোনো বিচারককে অস্থায়ী মেয়াদে আপিল বিভাগের বসার ব্যবস্থার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত বিচারক সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের অধীন বিচারক নিযুক্ত হওয়ার কিংবা অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে আরও এক মেয়াদে নিযুক্ত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কী পদ্ধতিতে এই অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হবে, কী পদ্ধতিতে হাইকোর্ট বিভাগের কোনো বিচারককে আপিল বিভাগের অস্থায়ী মেয়াদে বসার ব্যবস্থা করা হবে, কী পদ্ধতিতে অতিরিক্ত বিচারক থেকে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হবে বা মেয়াদ বাড়ানো যাবে– সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এতে করে যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনা ছাড়া বা রাজনৈতিক বিবেচনায় অতিরিক্ত বিচারক থেকে বিচারক নিয়োগ কিংবা মেয়াদ বাড়ানোর আশঙ্কা থাকে। একইভাবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের আপিল বিভাগের অস্থায়ী মেয়াদের জন্য বসার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনার সুযোগ থেকে যায়। 

এ সমস্যা সমাধানে সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ, তাদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ, মেয়াদ বৃদ্ধি কিংবা হাইকোর্ট বিভাগের 
বিচারকদের আপিল বিভাগে অস্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতা আইন নির্ধারিত পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই ও সুপারিশে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রদান কিংবা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের আপিল বিভাগের অস্থায়ী মেয়াদে বসার ব্যবস্থা করবেন। 
বর্ণিত প্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারকের নিয়োগ ও পদায়ন সম্পন্ন হলে উচ্চ আদালতের প্রতিটি বিভাগে দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন; যা বাংলাদেশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম করবে। 

মো. শরিফুল হক: আইন গবেষক ও লেখক
Shq.sharif@gmail.com

আরও পড়ুন

×