অধিকার
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামনে খাদ্য সংকট

জি. এম. আরিফুজ্জামান
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩ | ০২:৩০
রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার পূরণের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ নতুন নয়। সে খবরে আরও যুক্ত হলো জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসের মুখ্য মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকের দেওয়া বিবৃতি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ডুজারিক বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেছেন, দাতাদের তহবিল কমানোর কারণে সংস্থাটি কক্সবাজারের পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য জীবন রক্ষাকারী সহায়তা কমাতে বাধ্য হয়েছে।
তহবিলের ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ রেশন গত মার্চ মাসে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে মাসে ১০ ডলার করা হয়েছে। পরে গত জুনে তা আরও কমিয়ে ৮ ডলার করা হয়েছে। এ ছাড়া বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ রেশন দিতে ডব্লিউএফপির আরও ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রয়োজন। সাধারণ বিবেচনায়, যদি এই অর্থের সংস্থান করা সম্ভবপর না হয় এবং ক্রমান্বয়ে বাজেটকে হ্রাস করা হয় তাহলে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার সূচকের (যেমন– খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি) প্রতিটি বিষয়ের সংকট ঘনীভূত হবে। সবচেয়ে যে বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হতে পারে তা হলো খাদ্য সংকট। এই খাদ্য সংকট মোকাবিলায় যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্ভর করতে হচ্ছে দাতাদের ওপর।
রোহিঙ্গাদের সংকটের প্রভাব যে বাংলাদেশের ওপর পড়ছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্ধযুগ অতিবাহিত হলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত নেয়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক মহল থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য কোনো চাপ এখনও দৃশ্যমান নয়। এই প্রত্যাবর্তনের নামে বরং নানা ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে কূটনৈতিক মঞ্চে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জোর তৎপরতার কারণে এখনও বিশ্ববাসী রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ভুলে যায়নি। দীর্ঘদিন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে একটি বাড়তি ব্যয়।
গত মার্চের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, রোহিঙ্গাদের পেছনে বছরে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, গত তিন বছরে (৩৬ মাসে) রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের সরাসরি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। জেআরপির হিসাবে, ২০২২ সালে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বা ইউএনএইচসিআর থেকে প্রায় ৮৮ কোটি ডলার সহায়তার পরিবর্তে এসেছে মাত্র এর ৬২ শতাংশ। আগের বছর ৭০ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৯২ কোটি ডলারের চাহিদায় পাওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৯ কোটি ডলার; ২০২০ সালে ১০৫ কোটির পরিবর্তে মাত্র ৬৮ কোটি ডলার এবং ২০২১ সালে ৯৪ কোটি ডলারের বিপরীতে মাত্র ৬৭ কোটি ডলার। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর নিমিত্তে অর্থের যে প্রাপ্যতা, তার বিরাট ঘাটতি রয়েছে।
২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর যে সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল, বিগত ছয় বছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আরও অনেক। রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাদের জন্য সহায়তা। পাশাপাশি তাদের জীবনমান উন্নয়নে টয়লেট, গোসলখানা ও বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সুবিধাসহ নানাবিধ সুবিধার বিষয়ও মাথায় রাখতে হচ্ছে।
পাহাড় ও সংরক্ষিত বনভূমি কেটে রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি স্থাপনের কারণে পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমান্বয়ে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৩ সালের মে মাসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, গত সাড়ে পাঁচ বছরে অন্তত ১৬৪টি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গোলাগুলি, মাদক চোরাকারবারের মতো ঘটনাও নিয়মিত হয়ে উঠেছে খবরের পাতায়।
ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতির বিষয়টিও ‘ওপেন সিক্রেট’। এত কিছুর পরও বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী কর্মকাণ্ডের কারণে এখনও নিরাপদে বাস করতে পারছে রোহিঙ্গারা। আর্থিক সহায়তা হ্রাস, প্রত্যাবর্তন নিয়ে মিয়ানমারের নানাবিধ কৌশলের আশ্রয়, আন্তর্জাতিক মহলের রোহিঙ্গাদের জীবনমানের উন্নয়ন এবং প্রত্যাবর্তন নিয়ে কৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় প্রশ্ন হলো, এভাবে কতদিন চলবে? অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত নেওয়াটাই হবে মূল সমাধান। সার্বিক দিক পর্যালোচনায়, রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার পূরণের বিষয়টির সামনে অপেক্ষা করছে কী এক বিরাট সংকট!
জি. এম. আরিফুজ্জামান: সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
gmarif.cgs@du.bd