- মতামত
- রক্ষণের বদলে ভক্ষণ
রক্ষণের বদলে ভক্ষণ
পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ কমবেশি ১৫ শতাংশ। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মতে, বনভূমির পরিমাণ ৬ থেকে ৭ শতাংশ, যার এক-তৃতীয়াংশ আবার দখল হয়ে গেছে। এর সঙ্গে নানা উপায়ে বন উজাড় অব্যাহত রয়েছে। বন উজাড়ের এ অপপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বনশূন্য হয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
বাংলাদেশে বনাঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে বন বিভাগ। বন উজাড় প্রশ্নে তারা বরাবরই দাবি করে থাকে, পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে সঠিকভাবে বনভূমি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না। অসাধু ব্যক্তিরা তাদের দৃষ্টির বাইরে থেকে বন উজাড় করে। বন বিভাগের এ যুক্তি একেবারেই অসার নয়। আমরা জানি, শুধু বন বিভাগ নয়, সরকারি প্রায় সব দপ্তর ও বিভাগেই জনবল সংকট প্রবল। তবে প্রশ্ন হলো, বন বিভাগের জনবল এবং সক্ষমতা আছে- তা বন উজাড় রোধে কি নূ্যনতম ভূমিকা রাখছে?
বাংলাদেশে বন উজাড়, জলাভূমি দখল কিংবা পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপর্যয় ঘটে এমন কর্মকাণ্ডে সাধারণত প্রভাবশালীদের সংশ্নিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। তবে বন দখল কিংবা বন উজাড়ের সঙ্গে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ নতুন নয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত গড়ে তোলেন বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের যৌথ উদ্যোগে লোকচক্ষুর আড়ালে বন উজাড়ের কাজটি হয়ে থাকে। বিগত সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে এ ধরনের চিত্র উঠে এসেছে।
তবে এবার ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। বন রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিই কেটেছেন বনের এক হাজারের বেশি গেওয়া গাছ। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সাগর উপকূলের ভাটেরখীল এলাকায় কয়েক বছর আগে গাছগুলো লাগিয়েছিল বন বিভাগ। বনের জায়গায় মাছের ঘের করতে গাছগুলো কাটা হচ্ছে। সমকালের এক প্রতিবেদনে গাছ কাটার দায়িত্বে থাকা আবুল কাশেমের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ৩০ হাজার টাকায় গাছগুলো কাটছেন তিনি। এক হাজারের বেশি ছোট-বড় গাছ কাটা হলেও আরও এক হাজারের বেশি গাছ কাটা বাকি। সীতাকুণ্ডে ভাটেরখীল ফরেস্টের বিট কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম তাকে গাছগুলো কাটতে বলেছেন।
উপকূলীয় বন বিভাগ চট্টগ্রাম, সীতাকুণ্ড রেঞ্জের দাবি- নতুন গাছ লাগানোর জন্যই গেওয়া গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। ওখানে মাউন্ড নামে নতুন প্রজাতির গাছ লাগানো হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, উপকূলের জন্য যদি গেওয়া গাছগুলো ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে বন বিভাগ কেন এ গাছগুলো লাগিয়েছিল? বড় গাছ কেটে চারা রোপণের মধ্যে লাভ কীসে? তাহলে প্রভাবশালীদের হাতে বনের জায়গা তুলে দিতেই কি বন উজাড় করছেন বন বিভাগের কতিপয় অসাধু? ইতোপূর্বে সেখানে একইভাবে বনের জায়গা প্রভাবশালীদের দখলে যাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।
বনের গাছ কাটা, জোত বিক্রি ও পারমিট সরকারিভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও বন উজাড় করে কাঠ পাচার বন্ধ হয়নি। ফলে একের পর এক বনাঞ্চল বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে। আর বৃক্ষশূন্য ভূমি দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। এই কাঠচোর ও দখলদার চক্রকে সহায়তা দিচ্ছেন বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মাচারীরা। ফলে সারাদেশের বনাঞ্চল আজ বিপন্ন হতে বসেছে।
বন উজাড় প্রশ্নে বন বিভাগের অসাধু দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা ও অসততার বহু দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। বরাবরই তারা থাকেন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। এই অসাধু কর্মচারীদের শাস্তি পাওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানো ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সমুন্নত রাখতে বনভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বন ও বনভূমি রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বনভূমি রক্ষায় রাষ্ট্র যাদের রক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তাদেরই কেউ কেউ যদি এর বদলে ভক্ষণে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে বনের রক্ষা কোথায়? এই স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটাতে রাষ্ট্রকে কঠোর হতেই হবে। মনে রাখতে হবে- কাঠচোর, ভূমি দখলদার, প্রভাবশালী আর অসাধুদের অশুভ সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটন না করলে বৃক্ষশূন্যতার সে আশঙ্কা বেশি দূরে নয়।
সাংবাদিক
saifulksg@gmail.com
মন্তব্য করুন