
বাঙালি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল শুধু স্বাধীনতার জন্য নয়, একটি নতুন জাতীয় সংগীতের জন্যই নয়, একটি নতুন জাতীয় পতাকা বা ভূগোলে নতুন একটি মানচিত্র এঁকে দেওয়ার জন্যও নয়। আরও কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। বলা যায়, বাঙালির চিন্তায় সেদিন স্বাধীনতা ছিল বহুমুখী আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যয়ে পরিপূর্ণ। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' মনের মণিকোঠায় গভীরভাবে আত্মস্থ করেই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। নির্ধারিত লক্ষ্যগুলো ছিল- এমন একটা গণতন্ত্র চাই যেখানে 'আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব, সবাইকে যাচাই করে দেব।' এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, আইনের চোখে সব নাগরিক সমান বলে গণ্য হবে। সে ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ প্রভৃতির ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য থাকবে না। নাগরিক অধিকার হরণ করে এমন আইন বাতিল এবং নতুন করে তৈরি করা হবে না। দেশ সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে। মোটাদাগে এ বিষয়গুলোই সেদিনের বাঙালির অভিন্ন লক্ষ্য ছিল। বিগত ৫০ বছরে নতুন নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠলেও জনগণের সেই লক্ষ্যের পরিবর্তন হয়নি।
কোনো তত্ত্বের দরকার নেই। সাদা চোখে, মোটাদাগে মানুষের কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে, এমন অনেক ঘটনাই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। অতি সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা এ ক্ষেত্রে তুলে ধরা যায়। নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা অনেক ক্ষেত্রে বিঘ্নিত হচ্ছে, নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এটা যে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা-ও স্বীকার্য। নারী নির্যাতন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই পাপাচর যখন ব্যাপক হয়ে ওঠে, তখন জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন প্রণীত হয় এবং মাঝেমধ্যে এ ধরনের মামলার বিচার করে আদালতকে দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দিতেও দেখা যায়।
একজন বিচারপতির পুত্রের একটি দামি গাড়ি দ্রুতগতিতে চালানোর কারণে জনৈক নারী পুলিশ কর্মকর্তার বাবা আহত হন। বিচারকপুত্র তৎক্ষণাৎ থানায় গিয়ে একটি জিডি করেন। অন্যদিকে, নারী পুলিশ কর্মকর্তা থানায় মামলা করতে গেলে সেই মামলা নেওয়া হলো না। তখন সংবাদপত্রের পাতায় ঝড় উঠলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, যথাযথ তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে মামলা নেওয়া হবে। পরে মামলা নিলেও আসামি অজ্ঞাত। কেন? কেন ওই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হলো না? পত্রপত্রিকার রিপোর্ট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেশবাসী জানতে পারলেন, আসপিয়া ও মিম নামের দুই তরুণী 'ভূমিহীন' হওয়ার কারণে সব যোগ্যতা প্রমাণিত হওয়ার পরও পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত যদিও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মেয়ে দুটি জমি ও চাকরি উভয়ই পেতে চলেছে। কে জানে অতীতে আরও কত মিম ও আসপিয়া ওই গণবিরোধী আইনে চাকরি পাননি।
২০ ডিসেম্বরের একটি পত্রিকায় শিরোনাম 'গাজীপুরে ছাত্রলীগ নেতার ইয়াবা সিন্ডিকেট' শীর্ষক একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর সরকার টেন্ডার, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও ইয়াবা কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাহাঙ্গীর সরকার গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোদারচালা গ্রামের ইকবাল হোসেন সরকারের ছেলে। তার বাবা তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। তিনি এলাকায় চলেন প্রাডো গাড়ি নিয়ে। সম্প্রতি একটি গার্মেন্ট কারখানাও গড়ে তুলেছেন। জাহাঙ্গীর তার রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন ইয়াবার সিন্ডিকেট। দিন কয়েক আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জাহাঙ্গীর সরকারের প্রাইভেটকারে ইয়াবার চালানসহ তার ঘনিষ্ঠ চারজন গ্রেপ্তারের পর জেলাজুড়েই চলছে তোলপাড়। এমন হাজারো জাহাঙ্গীর এ জাতীয় কাজ করে চলেছে দেশব্যাপী। কখনও দেখি অমুক ছাত্রলীগ নেতা নারীসহ হোটেলে ধরা পড়েছে। কখনও বা কারও বুকে অস্ত্র ধরে তুলে নিয়ে গোপন আস্তানায় গিয়ে টাকা দাবি করে এবং বলে, চাহিদামাফিক টাকা না দিলে ছাড়া হবে না। মোবাইল কেড়ে নিয়ে তার মা-বাবাকে বলতে বাধ্য করে- শিগগির ওই টাকা না আনলে আমাকে বাড়ি ফিরতে দেবে না। খবরদার, এই খবর অন্য কাউকে বলো না, তাহলে আমি প্রাণে বাঁচব না।
সারাদেশে সড়ক-জলপথ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ নানা উন্নয়নমূলক দপ্তরের কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারির বেশির ভাগ পেশাদার অভিজ্ঞ ঠিকাদার ছাত্র-যুবলীগ নিয়ন্ত্রণ করছে- এমন অভিযোগ আছে বিস্তর। কলেজে ভর্তিবাজি, হোস্টেলে সিটবাজি, মিছিলে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের যোগ দিতে বাধ্য করা আজকের ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই সংগঠনটির অতীত উজ্জ্বল। দেশের সাংস্কৃতিক-গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অবদান কম নয়। ভেবে অবাক হই, ওরা যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্লোগান দিয়ে দুস্কর্মে লিপ্ত হয়, তখন খুব পরিতাপ হয়। এমনটি জাতির পিতাকে অবমাননার শামিল। তবে দুস্কর্মকারীদের মধ্যে কেউ কেউ কখনও সংগঠন থেকে বহিস্কৃত হয়, কিন্তু যে অপরাধ তারা করে চলেছে তা কি আইনের আওতার বাইরে থাকার মতো? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সহকর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগ গড়ে তুলেছিলেন। সেই ছাত্রলীগ আর আজকের ছাত্রলীগে কী বিস্তর পার্থক্য!
ছাত্র আন্দোলনের এমন চরিত্র কি একাত্তরের স্বপ্নে ও কল্পনায় বিন্দুমাত্র ছিল? যে বিপ্লবী ছাত্রসমাজ ঐতিহাসিক ১১ দফা দিয়ে ষাটের দশকে সারাদেশের রাজপথ-জনপথ প্রকম্পিত করেছিল, তারা আজ কোথায়? দুই দরিদ্র মেয়ে ভূমিহীন হওয়ার কারণে সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পুলিশে চাকরি পায় না, এসব বিষয়ে তো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কথা বলছে না! তারা দুর্নীতি, দলবাজি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা দূরের কথা, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই জঘন্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগ আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা আদর্শই বলি এখনকার ছাত্র নেতাকর্মীদের অনেকেই অতীতের বিপ্লবী ছাত্রসমাজের আদর্শিক উত্তরসূরি বলে দাবি করতে পারে না। বিষয়টি জাতির মনে প্রচণ্ড হতাশা সৃষ্টি করে।
পুরান ঢাকার নারিন্দার শাহ সাহেব লেনের একটি বাড়ি। 'টু-লেট' সাইনবোর্ড ঝুলছে তাতে। আলোচিত দুই সহোদর এনামুল হক ও রুপন ভুঁইয়ার ১৩টি বাড়ির একটি সেটি। ক্যাসিনো ও জুয়ার কারবার করে বিপুল বিত্তের মালিক হন তারা। জীবনের সবকিছুই রূপকথার মতো হঠাৎ করেই পাল্টে যায় তাদের। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের একপর্যায়ে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি গ্রেপ্তারের পর এখনও জেলেই আছেন তারা। তাদের সম্পদ এখন ভোগদখল করছেন তাদের স্ত্রী, ভাই ও স্বজন। অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ৮৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ১৩টি বাড়ির মধ্যে ১০টিই অবৈধ অর্থে কেনা। ১৩টি বাড়িই ২০১৪ সালের আগে কেনা। বাড়িগুলো কেনার অর্থের উৎস নিয়ে ছায়াতদন্ত চলছে। মানি লন্ডারিংয়ে তাদের বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়। সবক'টিরই চার্জশিট দিয়ে দিয়েছে পুলিশ। মামলাগুলো দুর্নীতির অভিযোগে করা। দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হলেও তাদের কোনো সম্পত্তি জব্দ করা হয়নি। শুধু এনামুল-রুপনকে গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছে থাকা ৪০ লাখ টাকা এবং কয়েক কেজি স্বর্ণ আটক দেখানো হয়। মামলার অপর দুই আসামি ২২ মাস ধরে পলাতক। চার্জশিটে এনামুল-রুপনসহ আটজনের নাম রয়েছে। এদের কারও কোনো কিছুই আর জব্দ করা হয়নি। যদিও কোটি কোটি অবৈধ টাকার মালিক হয়েছে তারা। ১০ তলা বাড়ি দখলে, স্ত্রী ও স্বজন সেগুলো দখল করে চলেছেন, সরকারের ট্যাক্স দিচ্ছেন আগের মতোই আসামিদের নামে। না আছে মামলা বিচারে তোলার ব্যবস্থা, না আছে কিছু জব্দ করা বা পলাতক কাউকে গ্রেপ্তারের তৎপরতা। জেলখানায়ও তারা আছে রাজার হালে- এমন খবরও সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। যেন কেউ নেই দেখার। অশুভ ছায়ার বিস্তারে সমাজে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এই ছায়া সরাতেই হবে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়- এ কোন দেশ? আমরা কি কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে সত্যিকার অর্থেই প্রত্যয়ী?
রণেশ মৈত্র: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য-ন্যাপ
raneshmaitra@gmail.com
মন্তব্য করুন