
উদ্ভাবন, গবেষণা ও ডাটা ডিজিটাল অর্থনীতির অপরিহার্য তিনটি উপাদান। ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে ভূমিকা রাখছে এমন আরও অনেক উপাদান রয়েছে। তবে আলোচ্য তিনটি উপাদান ডিজিটাল অর্থনীতির অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলেও বর্তমানে এর দ্রুত বিকাশে উদ্ভাবন ও গবেষণার অবদান সবচেয়ে বেশি। রূপক অর্থে উদ্ভাবন হলো, ডিজিটাল অর্থনীতির অক্সিজেন। আর গবেষণা হলো উদ্ভাবনের প্রাণ। উদ্ভাবন নিজেই গবেষণা দ্বারা চালিত। তাই উদ্ভাবন ও গবেষণা ছাড়া ডিজিটাল অর্থনীতি বিকশিত হতে পারে না। উদ্ভাবন ও গবেষণার পথে হেঁটেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় টাইগার অর্থনীতির দেশ হিসেবে খ্যাত সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের ডিজিটাল অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হয়। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে বর্তমানে যে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, তার নেপথ্যে কাজ করছে উদ্ভাবন ও গবেষণা। প্রকৌশল, উদ্ভাবন ও উন্নয়ন খাত থেকে দেশটিতে রাজস্ব আয় প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং যে জাতি বা সরকার ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তুলতে চায়, তাদের অগ্রাধিকার বিবেচনায় রাখতে হবে উদ্ভাবন ও গবেষণাকে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে একাডেমিয়া ও শিল্পকে। কারণ শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদ তৈরি করার জন্য শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আবার প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা ও উদ্ভাবনের উত্তম জায়গা শিক্ষা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সুতরাং উদ্ভাবন, গবেষণা, একাডেমিয়া ও শিল্প- চারটি ক্ষেত্রে সমন্বিত কার্যক্রমেই দ্রুত প্রসার ঘটছে ডিজিটাল অর্থনীতির। কভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখাই যখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, তখন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিজিটাল অর্থনীতিই সহায়ক খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), ইন্টারনেট অব থিংসসহ (আইওটি) অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবন ডিজিটাল অর্থনীতির দ্রুত বিকাশে ভূমিকা রাখছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল অর্থনীতি বাংলাদেশেও বিকশিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গবেষণা ও উদ্ভাবন কতটুকু ভূমিকা রাখছে। এ নিয়ে দেশে কোনো সমীক্ষা নেই। তবে এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) প্রণীত 'গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স (জিআইআই) ২০২১'-এর প্রতিবেদনে। এতে শিক্ষাসহ বিভিন্ন সূচকে আমাদের দুর্বল অবস্থান প্রকাশ পেলেও আশার সঞ্চারক সূচকটি হচ্ছে জ্ঞান ও প্রযুক্তির আউটপুট। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২তম। ডব্লিউআইপিওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উদ্ভাবনে বিনিয়োগের তুলনায় প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ফল তৈরি করে। বৈশ্বিক এ সংস্থার জিআই সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬তম; আর শিক্ষায় ১২৯তম। শিক্ষায় এই অবস্থান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদেরই বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি গবেষণার ক্ষেত্রে বিবর্ণ চিত্র উঠে এসেছে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে। 'গবেষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেশের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় এক টাকাও খরচ করেনি। এর মধ্যে আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি ১৬টি (সমকাল, ২৭ মে ২০২২)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানসহ উদ্ভাবন ও গবেষণার দেখভালে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনকে (ইউজিসি) অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন, উদ্যোক্তা তৈরি এবং জাতীয় উন্নয়নে অধিকতর সহায়ক গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে হবে।
জ্ঞান, উদ্ভাবন ও গবেষণা এবং রূপান্তরের সক্ষমতা- এই চার উপাদান মিলেই গড়ে ওঠে ডিজিটাল অর্থনীতির ইকোসিস্টেম। কিন্তু এমন একটি ইকোসিস্টেম গড়ার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উদ্ভাবন ও গবেষণার মতো সৃজনশীল কাজে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে না আসা। বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবন ও গবেষণায় ভালো করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রধানত মৌলিক গবেষণার কাজ হতে হবে এবং মৌলিক গবেষণার গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে গবেষণার বিষয়বস্তু যথাসম্ভব দেশের প্রয়োজনের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। যেমন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে দেশের প্রয়োজনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবন ও গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণার যখন চরম দুরবস্থা, তখন দেরিতে হলেও সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের সভায় যুগের চাহিদা, গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম বিষয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়েছে। উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানাতে হয় এ জন্য যে, এই কমিটি জাতীয় বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তু, পরিধি ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া বিষয়ে সুপারিশ করবে। এটা মনে রাখতে হবে, ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের অপরিহার্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলাকে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোরও নিজস্ব গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) ইউনিট থাকতে হবে। স্যামসাং, নকিয়ার মতো নামকরা কোম্পানির উত্থানের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা। আমাদের দেশে ওয়ালটনসহ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা থাকলেও অধিকাংশেরই তা নেই।
উদ্ভাবন ও গবেষণায় হতাশাজনক খবরের মাঝে আশার খবরও আছে। স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১-এ সরকার উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছে। জ্ঞান, উদ্ভাবন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিতে আগামীতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। উদ্ভাবন ও গবেষণায় নিবেদিতভাবে কাজ করার জন্য অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের নাম পরিবর্তন করে এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই) রাখা হয়েছে। উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকার, একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি মিলে ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্টের প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অ্যাস্পায়রার্স, অ্যাচিভার্স ও ইনোভেটরস- এই তিন স্তরে ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আমরা জানি, প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি, ই-কমার্স, এফ-কমার্স, গিগ ইকোনমি দেশে ডিজিটাল অর্থনীতির একটা বিস্তৃত পরিসর তৈরি করেছে। এর নেপথ্যের চালিকাশক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণা। পাঠাও, উবার, ওভাই, ট্রাক লাগবে; ফুডপান্ডার মতো উদ্ভাবনী স্টার্টআপ প্ল্যাটফর্ম শুধু ডিজিটাল অর্থনীতির আকার বৃদ্ধিতেই ভূমিকা রাখছে না; দেশে উদ্যোক্তাও তৈরি করছে এবং উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। ই-কমার্স খাতেও রয়েছে চালডালসহ নানা উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম। তাই আমাদের প্রত্যাশা, আগামীতে উদ্ভাবন হয়ে উঠুক ডিজিটাল অর্থনীতির অক্সিজেন এবং গবেষণা হোক উদ্ভাবনের প্রাণ।
অজিত কুমার সরকার: সিনিয়র সাংবাদিক
মন্তব্য করুন