- মতামত
- চিনির বাজারে অস্থিরতা ও চিনিশিল্পের সংকট
সমকালীন প্রসঙ্গ
চিনির বাজারে অস্থিরতা ও চিনিশিল্পের সংকট

আমদানিনির্ভর অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মতো চিনির বাজারেও চলছে অস্থিরতা। সমকালে প্রকাশিত সংবাদ- ব্যবসায়ীদের চাপে ১২ দিনে দুই দফায় কেজিপ্রতি চিনির দাম ২০ টাকা বাড়ানো হলেও নির্ধারিত দামে বাজারে মিলছে না।
এই অস্থিরতার পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস ইত্যাদির কথা বলা হলেও মূল কারণ বেসরকারি আমদানিকারকদের ওপর একক নির্ভরশীলতা। বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো এক সময় বছরে দেড়-দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত। কিন্তু গত দুই বছরে ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে ৬টির উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেশীয় উৎপাদন কমে ৩০ হাজার টনে নেমে এসেছে। এ কারণে দেশের চিনি খাত প্রায় শতভাগ আমদানিভিত্তিক বেসরকারি চিনিকলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার ফলে এই পণ্যের বাজারে সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানোর কথা বললেও বাস্তবে দেশীয় আখ থেকে স্বাস্থ্যসম্মত চিনি উৎপাদনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প খাতকে নিদারুণ অবহেলার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। অথচ যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হলে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো দেশে চিনির চাহিদার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারত। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করা যেত। সেই সঙ্গে হাজারো আখচাষি ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর সংকটের একটা বড় কারণ হলো, চিনির উৎপাদন খরচ আমদানি করা চিনির বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণ দ্বিবিধ। এক, চিনিকলগুলো সারাবছর মাড়াইয়ের মতো পর্যাপ্ত আখ পায় না বলে বছরের বড় সময়জুড়ে বন্ধ থাকে। যদিও বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন স্থির খরচ সারাবছরই বহন করতে হয়। দুই, মাড়াই করার জন্য যে আখ পাওয়া যায়, তা থেকে চিনি আহরণের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম- ৬ থেকে ৭ শতাংশ। ভারত বা ব্রাজিলে এই হার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। ফলে টনপ্রতি আখ থেকে চিনি উৎপাদন হয় কম। চিনি উৎপাদনে ব্যায়ের প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ হয় কাঁচামাল বাবদ। চিনি আহরণের অতি নিম্নহারের কারণে বাংলাদেশে চিনিকলগুলোর কাঁচামাল বাবদ খরচ ভারতীয় চিনিকলগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ, যা প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে বাড়তি খরচ হিসেবে যোগ হয়।
প্রশ্ন হলো- কেন মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত আখ পাওয়া যাচ্ছে না এবং কেন আখ থেকে চিনি আহরণের হার কম? মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণ- খরচের তুলনায় আখের দাম পাওয়া যায় না; চিনিকলে সময়মতো বিক্রি করা যায় না। বিক্রি করলেও সময়মতো অর্থ পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকরা আখের বদলে ধান বা সবজি চাষ করছেন। আর যাঁরা আখ চাষ করছেন তাঁরা চিনিকলের বদলে গুড় উৎপাদকের কাছে বিক্রি করছেন। এ ছাড়া চাষাবাদ ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকটের কারণে বাংলাদেশে একরপ্রতি আখের ফলন গড়ে ১৮-১৯ টন। ভারতে একরপ্রতি গড় আখ উৎপাদন ২৮ টন।
বাংলাদেশের চিনিকলগুলোয় আখ থেকে চিনি আহরণের হার এত কম হওয়ার কারণ কী? চিনিকল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, কৃষকদের কাছ থেকে কেনা আখের চিনি ধারণক্ষমতা ৮ থেকে ৯ শতাংশ। ফলে ২ দশমিক ৩৫ থেকে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ কারখানা লস বাদ দিলে কার্যকর চিনি আহরণের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে ইক্ষু গবেষণা সংস্থার বক্তব্য- আখে চিনির পরিমাণ ১২ শতাংশের কম থাকে না। কারখানাগুলোতে চিনি লস বেশি হওয়ার কারণেই আহরণের হার কম। কারখানাগুলো এই লস অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে দেখার জন্য ব্যাক ক্যালকুলেশন করে আখের চিনির হার কম দেখায়!
আখে চিনির হার কম হওয়ার আরেকটি কারণ, অঞ্চলভেদে মাটির বৈশিষ্ট্য, জমির উচ্চতা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে উপযুক্ত জাতের আখ চাষ যথাযথভাবে না হওয়া। আবার আখে চিনি থাকলেও সময়মতো পরিবহন করতে না পারার কারণে বা কারখানায় নেওয়ার পর সময়মতো মাড়াই না হওয়ার কারণে আখ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ চিনি আহরণ করা যায় না।
অন্যদিকে আখে চিনি থাকলেও কারখানায় প্রসেসিংয়ের সময় আখ থেকে চিনি কম আহরণ হওয়ার কারণ- আখ মাড়াই করে রস বের করার যন্ত্র (রোলার) ঠিকঠাক কাজ না করা; মেয়াদোত্তীর্ণ, নষ্ট ও পুরোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার; কোনো যন্ত্র হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আহরিত রসটুকু নষ্ট হওয়া; রস প্রক্রিয়াজাত করার সময় রসের তাপমাত্রা ও অম্লত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হওয়া ইত্যাদি। নষ্ট ও পুরোনো যন্ত্র ব্যবহারের কারণে শুধু যে চিনি কম আহরিত হচ্ছে, তাই নয়; সেই সঙ্গে প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, আখ মাড়াইকালে সময়ের অপচয় ইত্যাদিও বেশি হচ্ছে। যার ফলে চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
পাশাপাশি প্রতি বছর ঋণের সুদ বাবদ বিপুল অর্থ খরচ হওয়ার কারণেও চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। গড়ে চিনির উৎপাদন খরচের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই হলো ঋণের সুদ।
চিনিকলগুলোর লোকসানের আরও একটি গুরুতর কারণ- আমদানিকৃত চিনির চেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ও ভালো চিনি হিসেবে দেশীয় চিনিকলগুলো থেকে উৎপাদিত চিনির বাড়তি চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক চিনি সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন না আনা। ফলে ডিলার থেকে পাইকারি বিক্রেতা এবং পাইকারি থেকে খুচরা বিক্রেতার কাছে চিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছায় না। ফলে একদিকে আগ্রহী ক্রেতা বাজারে দেশি চিনি খুঁজে পায় না; অন্যদিকে চিনিকলগুলোর গুদামে অবিক্রীত চিনি নষ্ট হতে থাকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প ও আখ চাষের এসব সমস্যা নতুন নয় এবং এগুলোর সমাধানের উপায়ও সংশ্নিষ্টদের বহুদিন ধরেই জানা। কিন্তু জানা থাকার পরও এসব সুনির্দিষ্ট সমস্যা-সমাধানের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিয়ে চিনিকলগুলো বন্ধ করে ও অবহেলা করে চিনিশিল্পের এ সংকট আরও ঘনীভূত করা হচ্ছে। আমরা আশা করব, সাম্প্রতিক ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশীয় উৎপাদনের গুরুত্ব যেভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তার কারণে হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প পুনরুজ্জীবনে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কল্লোল মোস্তফা: লেখক, প্রকৌশলী; নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা
মন্তব্য করুন