সর্বজনের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে পরিবেশ চেতনা কোনো শখের বিষয় নয়; জীবন-জীবিকা আর সংস্কৃতিরই অংশ। পরিবেশ রক্ষা প্রান্তিক মানুষের কাছে সময় কাটানোর উপাদান নয়; তার জীবনেরই অংশ। ফুলবাড়ীর জনগণ যখন জল-জমি-জীবন রক্ষার জন্য ফুলবাড়ী অভ্যুত্থান ঘটায়, তখন তা রক্ত-ঘাম-শ্রমের বিনিময়ে জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়েরই অংশ।

এদিকে দেশে চলমান উন্নয়ন মডেল পরিবেশের বিষয়ে সংবেদনশীল নয়। এই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নধারার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এটি নিম্ন মজুরি ও উচ্চ পরিবেশদূষণের ওপর ভিত্তি করে ঘটছে। এ দেশের শ্রমিকদের শ্রম যেমন সস্তা, পরিবেশও তেমনি সস্তা। ফলাফল হিসেবে ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে পরিবেশ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। যে প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে এই পরিবেশ শোষণ চলছে, তাতে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী স্বল্পমেয়াদে আর্থিকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা সেই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথেই বিরাট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

যেমন, বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিদিন শুধু বুড়িগঙ্গাতেই ফেলা হয় ৯০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত তরল শিল্পবর্জ্য। শিল্প-কারখানাগুলোয় বর্জ্য শোধনাগার না থাকায় এবং কিছু কারখানায় থাকলেও তা ব্যবহৃত না হওয়ায় এমনটি ঘটছে। প্রতি ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে ৩০ টাকা প্রয়োজন হয় বলে মূলত ‘ব্যয় সাশ্রয়’ করতে বছরের পর বছর অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে।

কলকারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করে নদনদী ও খাল-বিলে ফেললে গুটি কয়েক কারখানা মালিকের স্বল্পমেয়াদে আর্থিক লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সর্বজন। দূষিত পানিতে মাছ উৎপাদন কমে যায়। ফলে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানিদূষণের কারণে মাটিও দূষিত হয়। ফলে শুকনো মৌসুমে বিলে ফসল উৎপাদন কমে যায়। খাল-বিল, নদনদীর দূষিত কালো দুর্গন্ধযুক্ত পানি ব্যবহারের কারণে চারপাশের মানুষের অসুখ-বিসুখ বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়; নদনদীর দূষিত পানি ভূগর্ভের পানির স্তরকেও দূষিত করে। ওই ভূগর্ভ থেকেই আমাদের খাওয়া ও সেচের পানির বড় অংশের জোগান আসে, যা খাবারের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে প্রাণঘাতী সব রোগের সৃষ্টি করে।

যেমন গত এক দশকে গাজীপুরে বহু শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। কিন্তু তার জন্য ধ্বংস করা হয়েছে বিপুল আয়তনের বন ও জলাভূমি। গাজীপুরে যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে, তার মধ্যে ৪৮০টি কারখানা থেকে ক্ষতিকর তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৩৫টি কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার-ইটিপি স্থাপনই করা হয়নি। আবার যেসব কারখানার ইটিপি আছে, সেগুলোরও একটা অংশ খরচ বাঁচাতে এটি বন্ধ রাখে। ফলে নদনদী, ফসলি জমি দূষিত হয়।

গাজীপুর সদর, কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ ও শ্রীপুর উপজেলার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বেলাই বিলের দূষণের দিকে তাকানো যেতে পারে। টঙ্গী, বোর্ডবাজার, জয়দেবপুর, রাজেন্দ্রপুর ও শ্রীপুর এলাকার শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য তুরাগ, চিলাই ও বালু নদের পানি দূষিত করছে। সেই দূষণ খালের মাধ্যমে বেলাই বিলকেও দূষিত করছে। ফলে যেখানে ৯০ দশকে প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ধান পাওয়া যেত ২৪ থেকে ২৫ মণ; দূষণের কারণে ফলন কমতে কমতে বর্তমানে বিঘাপ্রতি ১৩-১৪ মণে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ-ছয় বছর আগেও এক দল জেলে যেখানে গড়ে প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ কেজি মাছ পেত; দূষণের কারণে কমতে কমতে তা সাত-আট কেজিতে নেমে এসছে। এভাবে দূষণে মাছ কমে যাওয়ায় জেলেরা পেশা ছেড়ে দিনমজুরি করতে বাধ্য হয়েছে (প্রথম আলো,  ২২ নভেম্বর ২০২২)।

এবার দেখা যাক বাংলাদেশে বায়ুদূষণের পরিস্থিতি কী। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইকিউএয়ার প্রণীত বায়ুমান প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে এ দেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ছিল ৭৬.৯ এবং রাজধানী ঢাকার বাতাসে এর পরিমাণ ছিল ৭৮.১। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫ থাকার কথা ১০-এর কম।

বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হলো ফিটনেসহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানা ও ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া, অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্ট ধুলা। ফিটনেসহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চালিয়ে, জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে কলকারখানা ও ইটভাটা থেকে পরিশোধন ছাড়াই দূষিত বায়ু নির্গত করে এবং যথাযথ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মাণকাজ, নির্মাণসামগ্রী পরিবহন ও মজুত করে রাখার মধ্য দিয়ে কয়েক হাজার পরিবহন মালিক, কারখানা মালিক কিংবা ঠিকাদার গোষ্ঠী আর্থিকভাবে লাভবান হলেও শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গোটা দেশের মানুষ।

বাংলাদেশের বাতাস যখন পিএম ২.৫, সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের অতি ঘনত্বের কারণে বিষাক্ত; সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে বায়ুদূষণকে আইনি বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনুধাবন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যেখানে বস্তুকণা ২.৫-এর মানমাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম থেকে কমিয়ে ৫ মাইক্রোগ্রাম করেছে, সেখানে বাংলাদেশে সম্প্রতি পাস হওয়া বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২-এ বায়ুর মানমাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম করা হয়েছে (দেশে নতুন বিধিতে বায়ুদূষণে ছাড়, সমকাল, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।

কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম), সালফার ডাই-অক্সইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের অনুমোদিত মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২০ সালের আগে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যথাক্রমে ১০০, ৪০০ ও ৪০০ মিলিগ্রাম এবং ২০২০ সালের পরে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৫০, ২০০ ও ২০০ মিলিগ্রাম [বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২, তপশিল ৫]; অথচ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী জাপান ও চীনে এসব বায়ুদূষণকারী উপাদানের অনুমোদিত মাত্রা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কঠোর।

এভাবে দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফার স্বার্থে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি অবহেলার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষ বেশি হারে শ্বাসকষ্ট, কাশি, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে গড়ে প্রতি বছর ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ বায়ুদূষণের শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করছে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষ যে শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নয়। মানসিক রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে অনেক। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ (ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ২০২২)।

কাজেই পরিবেশদূষণের সমালোচনা করা কোনো বড়লোকি ব্যাপার নয়, বরং এ বিষয়ে সমালোচনা না করলেই বড়লোকের স্বার্থ রক্ষা হয়। সবার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশ রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল পরিবেশ প্রশ্নকে অবহেলা করে শুধু আর্থিক প্রবৃদ্ধিকেই বড় করে দেখায়, তা কতিপয়ের স্বার্থে সর্বজনের বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ধরনের পরিবেশবিধ্বংসী অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলকে প্রত্যাখ্যান করা তাই জরুরি।

কল্লোল মোস্তফা: বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক