সুরাইয়া, এই-ই কি জীবন?

বাবা জালাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সুরাইয়া আহমেদ
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪ | ২০:২৯ | আপডেট: ২৯ মে ২০২৪ | ২২:০৩
রিজার্ভের ওঠা-নামা নিয়ে তাদের হয়তো আগ্রহ নেই। জীবন বলতে তারা বোঝেন চাল-ডাল, সবজি, তেল-নুনের দাম বাড়ল না-কি কমল। চাকরির মাইনের টাকা নিয়ে মাস শেষে হিসাবের খাতা মেলাতে বছরের পর বছর কাটে তাদের। সন্তানের স্কুলের বেতন পরিশাধে, সংসারের খরচের টালি খাতায় বকেয়া না থাকলেই বড্ড খুশি। সব দেনা চুকিয়ে মাস শেষে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য সামান্য কিছু ‘ডিপোজিট’ রাখতে পারলে তাদের মনে হয়, ‘এই তো সার্থক জীবন’।
১০ বছরের সন্তান সুরাইয়াকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেই সমকালের সহকর্মী জালাল আহমেদ দক্ষিণখানের টিনের চালার বাসায় প্রতিদিনের মতো ঘুমিয়ে ছিলেন। মা-বাবার কোলই তো সন্তানের নিরাপদ ঠিকানা। হায় জীবন! পাশের বহুতল ভবন থেকে দেয়াল ধসে জালালের টিনের চালের ওপর পড়ে। চাল ভেঙে ভারি দেয়াল ঘুমন্ত জালাল ও তার মেয়ের শরীর চেপে ধরে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায় ফুটফুটে ছোট্ট শিশু সুরাইয়া। ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে থাকার পর আজ (বুধবার) মিথ্যে মায়ার নগর থেকে বিদায় নিল সুরাইয়া। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জালাল এখনো জানেন না, কী রত্ন তিনি হারালেন!
আরও পড়ুন: আইসিইউ থেকে ফেরানো গেল না সুরাইয়াকে
বুধবার বেলা পৌনে ১১টা পর্যন্ত চেষ্টা চলে সুরাইয়াকে বাঁচানোর। কিন্তু কোনো আশা না দেখে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসাধীন সুরাইয়ার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। দেয়াল ধসে আহত হওয়ার পর থেকেই মেয়েটি অচেতন ছিল। আর চেতনে ফেরা হলো না তার। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সুরাইয়ার বাবা আহত জালাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি দৈনিক সমকালের মার্কেটিং বিভাগে সিনিয়র নির্বাহী।
এদিকে মানুষ ছুটছে। সময়ের বাইরে কারো জন্য এক মুহূর্তে স্টেশনে মেট্রোরেল থামবে না। তবে জীবন নামক গাড়িটা সত্যি থমকে গেল আমাদের প্রিয় সহকর্মী জালালের। তার গাড়ির ইঞ্জিনের গতি রিজার্ভ ওঠানামার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। এই ইঞ্জিন চলত সুরাইয়ার হাসি-কান্নার গতি দেখেই! ওপারে ভালো থেক মা! আমাদের ক্ষমা করে দিও! সন্তানের তিন বছর পার হলে জাপান শেখায় কীভাবে একাকী রাস্তায় হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। তারা শেখায়, কারণ তারা জানে তাদের সড়ক নিরাপদ, বসতি নিরাপদ, সমাজ নিরাপদ। আর আমরা কোলে-পিঠে রেখেও সন্তানের জীবন রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি!
স্বপ্ন বাস্তবায়নের টানে এই ঢাকায় ছুটে আসছেন লাখো মানুষ। পলি মাটির অববাহিকা, পাহাড়ের মায়া ও নদী-সমুদ্রের কোল থেকে নিজেদের শিকড় একটু আলগা করেই প্রতিনিয়ত ঢাকার মরিচিকার পেছনে ছুটছে কতজন। কেউ এখানে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করেন। কেউ কেউ সফলও হন। আবার সফল হওয়ার চেষ্টায় কেউ জীবন পার করে দেন। জীবন সায়াহ্নে এসে অনেকে আবার ফিরে যান মা-মাটির টানে। আবার কেউ ফিরতে চাইলেও মরীচিকা চারপাশ ঘিরে রাখে। প্রেম-মায়া, স্বপ্ন, প্রত্যাশা, প্রতারণা আর হতাশার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই নগরেরই কোনো এক কোণায় শেষ শয্যা নেন। কিছু দিন পার হওয়ার পর তাদের শেষ শয্যার পাশে গিয়ে দু ফোটা অশ্রু ফেলবারও কেউ থাকে না। মিথ্যে মায়ার এই নগরের পথে প্রান্তরে নানা মরণ ফাঁদ অনেককে একটু নিশ্চিত হয়ে ঘুমাতে দেবে না।
তারপরও আমরা আশায় বসত বাঁধি। কিন্তু যখন বুকের সোনামানিক এভাবে অকালে দুঃসহ ব্যথা পেয়ে চলে যায়, যখন এরকম ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে, তখন বলতে ইচ্ছা হয়, এটাই কি জীবন, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’!
- সাহাদাত হোসেন পরশ: উপপ্রধান প্রতিবেদক, সমকাল