ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

স্মরণ

আলোকবর্তিকা

আলোকবর্তিকা

বেগম রোকেয়া

রিক্তা রিচি

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৫

নারীর লেখাপড়া, নারীর জাগরণ, নারীর স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়য়ে প্রশ্ন উঠলেই প্রথমে অকুণ্ঠ চিত্তে উচ্চারিত হয় বেগম রোকেয়ার নাম। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে তিনি ছিলেন এক নির্ভীক প্রাণ, যিনি কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে স্বশিক্ষিত হয়েছেন। শুধু নিজেকে শিক্ষিতই করেননি; প্রজন্মের পর প্রজন্ম নারীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার অলিখিত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনিই সেই নারী, যিনি বাঙালি নারীদের শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন দেখেছেন। একই সঙ্গে নারী-পুরুষ সাম্যের এক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। শতবর্ষ আগে দেখা সেই স্বপ্নেরই প্রতিফলিত রূপ আমরা দেখতে পাই বর্তমান সমাজে। যদিও পথে পথে অনেক কাঁটা; তবুও বলা যায়, আজকের নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীন। তারা জয় করছে পর্বত, সমুদ্র; উড়ছে আকাশে। আজকের নারীরা শিক্ষা, খেলাধুলা, রাজনীতি, অভিনয়; সর্বক্ষেত্রে স্থান করে নিচ্ছে বিশ্বদরবারে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছে এ সময়ের শিক্ষিত ও সচেতন নারী। এসব ক্ষেত্রে ‘আলোকবর্তিকা’ বেগম রোকেয়া। আজ তাঁকে স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধায়। 

চার দেয়ালের মাঝে বন্দি রোকেয়া লেখাপড়ার জন্য খুব সামান্য সুযোগ পেয়েছেন, বলা যায়। কেননা, তখন নারীদের জীবন ছিল নিগৃহীত। ঘরের মেয়েরা বাইরে যাবে কিংবা পর্দা ছাড়া চলবে– এ বিষয়গুলো ছিল কল্পনাতীত। আর লেখাপড়া করা তো বহু দূরের কথা। বেগম রোকেয়ার ছোট্ট মনে সেসব চার দেয়াল, কুসংস্কার, নারীর অবমাননা, সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ভীষণ আঘাত হানতে থাকে। ভেতরে ভেতরে তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠেন। সেই তৃষ্ণা ছিল জ্ঞানলাভ, মুক্তি ও জাগরণের। তাই তো নিজ উদ্যোগে এক প্রকার লুকিয়ে-চুরিয়ে বই পড়া শুরু করেন। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের কাছ থেকে ইংরেজি শেখেন তিনি। তাঁর উদ্যম ও ইচ্ছাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন বড় বোন করিমুন্নেসা। তাদের অনুপ্রেরণায় বেগম রোকেয়া বাংলা, ইংরেজিসহ উর্দু, আরবি, ফারসি ভাষায়ও দক্ষতা লাভ করেন। বিয়ের পর স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের অনুপ্রেরণায় তিনি এগিয়ে যান। কেননা, সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন নিজের চেষ্টায় গড়ে ওঠা একজন উচ্চশিক্ষিত, আদর্শবাদী মানুষ। স্বামীর মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া গড়ে তোলেন স্কুল। সেখানে ছিল মাত্র পাঁচজন নারী শিক্ষার্থী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি অভিভাবকদের বোঝাতেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব। এর ফলে দ্বারে দ্বারে অবহেলিতও হয়েছেন। বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, তবু থেমে থাকেননি। অভাবনীয় আর্থিক অসুবিধা, সামাজিক বাধা মোকাবিলা করেই তিনি এগিয়ে যান। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু মানবহিতৈষীর সহযোগিতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল ক্রমে শক্তি লাভ করে। 

এবার আজকের সমাজে আসি। বেগম রোকেয়া পুরুষতান্ত্রিকতা, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, নারী অবমাননার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি ও জীবন দিয়ে কুসংস্কার দূর করতে চেয়েছিলেন। তা হয়েছে বটে, কিন্তু আজও কি নারী পথে-ঘাটে; ঘরে-বাইরে স্বাধীন? আজও কি নারী পেরেছে পুরুষতান্ত্রিকতার বাইরে আসতে? হ্যাঁ, অকপটে স্বীকার করতেই হয়, আমূল পরিবর্তন এসেছে। তবে পুরুষতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক সমাজে নারীকে নিয়ে ভোগপণ্য মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। নারীর পোশাক নিয়ে বিদ্রুপমূলক মন্তব্য বন্ধ হয়নি। প্রতিনিয়ত ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য সেসব কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। নারী রাতবিরাতে একা চলতে পারে না। বাসে হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও কন্যাশিশু জন্ম দিতে অনেক বাবা-মা দ্বিধাবোধ করেন! 

আজও অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নারী হলে অধস্তন পুরুষরা তা মেনে নিতে পারেন না। আজও রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান নগণ্য। আজও নারী কী করবে, কোথায় যাবে, কোন পোশাক পরবে, কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবে– তার সিদ্ধান্ত নারী নিজে নেয় না। তাহলে নারীর মতামত ও স্বাধীনতা কোথায়? শেষ করছি এই বলে, বৈষম্যবিরোধী, কল্যাণকামী নতুন দেশ গঠনে যেসব ছাত্রছাত্রী আন্দোলন করেছে, তাদের মধ্য থেকে কতজন নারী শিক্ষার্থী উপদেষ্টা হয়েছে? হয়নি তো। তারা কি আন্দোলনে ছিল না? তাদের কি মেধা-শক্তি-শিক্ষা-সামর্থ্য কম? না বোধ হয়। কিন্তু তারা আলোচনায় সেভাবে নেই, যেভাবে পুরুষ শিক্ষার্থীরা আছে।    

রিক্তা রিচি: কবি ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×