জনপ্রশাসন
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য এখন দূর না হলে, কখন?
লোগো
মুহাম্মদ আব্দুছ ছালাম
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৫৪
বৈষম্যহীন ও মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসনের মাধ্যমেই প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। বাংলাদেশের ২৬ ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের চেয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বেশি সুবিধা ভোগ করেন। অথচ প্রতিটি ক্যাডারের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পদধারী কর্মকর্তাই মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন।
যেমন– প্রশাসন ক্যাডারের সর্বনিম্ন পদ সহকারী কমিশনার (ভূমি), সর্বোচ্চ পদ বিভাগীয় কমিশনার। শিক্ষা ক্যাডারে সর্বনিম্ন পদ প্রভাষক, সর্বোচ্চ পদ অধ্যাপক। এ রকমই সব ক্যাডারের পদ সোপান, যারা মূলত মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সমস্যা, সম্ভাবনা ও করণীয় বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ফলে সরকার যদি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কৌশল প্রণয়নে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাঝ থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে দক্ষ, যোগ্য, পারদর্শী কর্মকর্তাকে প্রথমে উপসচিব, উপসচিব থেকে একইভাবে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে নিয়োগ দেয় তাহলে জনপ্রশাসন, জনকল্যাণ, জনসেবা; সর্বক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার উন্নয়ন হবে– এটা বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে সর্বজনীন ও সুষম এমন ব্যবস্থা না হয়ে শুধু একটি ক্যাডার, প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা সরকারের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের পদে নিয়োগ পেয়ে আসছেন।
ফলে সরকারের একেবারে কাছাকাছি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকার সুবাদে সরকারের সব সেক্টরের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নিজেদের অপরিহার্য অংশ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন এ ক্যাডারের লোকজন। একই সঙ্গে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত ২৬ ক্যাডারের সদস্যদের পদোন্নতি, পদ সৃজন, পদায়ন, ট্রেনিং, প্রেষণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ ও নিশ্চিতের বিষয়টি তাদের হাতে থাকায় প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা উল্লিখিত ক্ষেত্রে যত প্রাধিকার পাচ্ছেন, সেই তুলনায় বাকি ২৫ ক্যাডারের প্রাপ্যতা যৎসামান্য। আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের মূল এখানেই নিহিত।
২৬টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সবচেয়ে নিয়মিত পদোন্নতি হয় একমাত্র প্রশাসন ক্যাডার সদস্যদের। তাদের পদোন্নতি হয় প্রতি টায়ারে, ব্যাচ ধরে; সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগ্যতা অর্জিত হলেই। অর্গানোগ্রামে পদ থাকুক বা না থাকুক, তাদের পদোন্নতি রুটিন অনুযায়ী চলমান। পদোন্নতির জন্য এ ক্যাডারের সদস্যদের কোনো কষ্ট নেই। এমনকি এ ক্যাডারে একই টায়ারে একাধিকবার পদোন্নতি হয়। প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত সূত্র অনুযায়ী, সমকাল ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর রিপোর্ট করে ‘সময়ের সঙ্গে নেই জনপ্রশাসন’ শিরোনামে। ওই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, উপসচিবের অর্গানোগ্রামভুক্ত পদ ৩৫০; কর্মরত ১ হাজার ৬৩৩ জন উপসচিব। যুগ্ম সচিবের অর্গানোগ্রামভুক্ত পদ ২৭২; কর্মরত ৭১৬ জন। অতিরিক্ত সচিবের অর্গানোগ্রামভুক্ত পদ ১০০; কর্মরত ৪২৭ জন।
আজকের পত্রিকা ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতিতে বৈষম্য তুলে ধরে ‘একই পদে ঘুরপাক শিক্ষা ক্যাডারদের’ শিরোনামে রিপোর্ট করে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, অন্য ক্যাডারে শিক্ষার্থীরাও শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের চেয়ে উঁচু পদে। তাই তো পদ না থাকার পরও সময়মতো পদোন্নতি আর সুযোগ থাকার পরও বছরের পর বছর পদোন্নতি না পাওয়া এই দুই ভাগে মূলত ক্যাডার কর্মকর্তারা বিভক্ত। প্রথম ভাগে প্রশাসন ক্যাডার, অন্যভাগে বাকি ২৫ ক্যাডার। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য এ রকমই। পদ সৃজনের বেলায়ও বৈষম্য।
প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের সব প্রজেক্টের পরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালক, উপপরিচালক পদে পদায়ন পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, ব্যানবেইসসহ বেশ কিছু অফিস, যেগুলোর অর্গানোগ্রামে পদগুলো শিক্ষা ক্যাডারের জন্য সৃষ্ট; সেগুলোতে শিক্ষা ক্যাডারদের পদায়ন ন্যায়সংগত। সেখানেও প্রশাসন ক্যাডার সদস্যরা পদায়ন নিচ্ছেন। অন্যান্য ক্যাডারের বেলায়ও অনুরূপ। যেমন পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা পদায়ন পাচ্ছেন। এটাও বৈষম্য। একটি ক্যাডারের সদস্যরা সব জায়গায় পদায়ন পেতে পারেন, অথচ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান থাকার পরও নিজ ক্যাডারের সদস্যরা পদায়ন পাচ্ছেন না। ফলে সেবা ও উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে কিনা, সন্দেহ।
ক্যাডারে ভিন্নতা থাকলেও চাকরির ১০ বছর পূর্ণ হলে যে কোনো ক্যাডারের কর্মচারী উপসচিব পুলভুক্ত হতে পারেন। সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান এই যে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য, তার নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। আসলে যে স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, একটি ক্যাডার বাদে বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সম্ভবত তা পারছেন না। চোখের সামনে এত বৈষম্য থাকার পর না পারারই কথা। এ ছাড়া বিদ্যমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের ফলে সমাজে মানুষের মাঝে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। এ জন্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহা বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
মুহাম্মদ আব্দুছ ছালাম: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ, মানিকগঞ্জ
- বিষয় :
- প্রশাসন ক্যাডার