বাম গণতান্ত্রিক জোটে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সাত দলের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় থাকা নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ 'গণতন্ত্র মঞ্চে'র কার্যক্রমে বাম জোটের দুই শরিক দল যুক্ত হওয়ায় মতবিরোধ চরমে উঠেছে। নতুন ওই মঞ্চের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়েও বাম জোটে রয়েছে প্রবল মতবিরোধ। ফলে বামপন্থিদের বৃহত্তর এই জোটে ভাঙনের আশঙ্কাও করছেন অনেকেই।

কয়েকদিনের মধ্যে বাম জোটের কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেখানে অভ্যন্তরীণ এসব বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্নেষণের পাশাপাশি পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে।
চলতি মাসে সাতটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতৃত্বে সরকারবিরোধী 'গণতন্ত্র মঞ্চে'র আত্মপ্রকাশ করার কথা রয়েছে। নতুন এ মোর্চায় যুক্ত হয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি দল জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন এবং সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। নতুন এই রাজনৈতিক মঞ্চের অন্য পাঁচটি সংগঠন হচ্ছে- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ভাসানী অনুসারী পরিষদ, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য, ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ এবং হাসনাত কাইয়ুমের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

কয়েক মাস আগে নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই গণসংহতি আন্দোলন এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই দুই দলের নেতারা বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্য শরিকদেরও তাদের কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং বর্তমান সরকারের 'ফ্যাসিবাদী শাসনে'র বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য ও আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে নতুন এই মোর্চা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। যা বাম জোটের বিকল্প নয় এবং এর আদর্শিক রাজনীতির কোনো ক্ষতিও করবে না। তাই বাম জোটে থেকেও বা এটিকে বহাল রেখেই নতুন মঞ্চে যুক্ত হওয়া যেতে পারে।

তবে বামপন্থি নয়টি দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বাম জোটের অন্য সাত সংগঠনেরই এ বিষয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে, নতুন মঞ্চের উদ্যোক্তারা আগে থেকেই বুর্জোয়া ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন দল বিএনপি ও তার মিত্রদের সঙ্গে মিলে নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। কেউ কেউ এখনও জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে। তাই নতুন মঞ্চে যুক্ত হলে জনগণের মধ্যে তেমন আলোড়ন দেখা দেবে না। সিংহভাগ শরিকের এমন আপত্তি ও দুই শরিকের নতুন মঞ্চে যুক্ত হওয়া নিয়েই মূলত বাম জোটে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
দেশে বামপন্থি রাজনীতির নানামুখী জোট ও মোর্চা গঠনের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়। শুরুতে এই জোটে আটটি দল ছিল। দলগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী), ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে একটি অংশ বের হয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নামে নতুন দল গঠন করে বাম জোটে যুক্ত হয়েছে। এতে বাম জোটের শরিক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে নয়টিতে।

বাম জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কেবল তিনটি দল সিপিবি, বাসদ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। এর বাইরে গণসংহতি আন্দোলনের নিবন্ধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাজনীতির মাঠে এই চারটি বাম দলেরই মোটামুটি একা ভালো অবস্থান রয়েছে। এ অবস্থায় বাম জোট থেকে গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বেরিয়ে গেলে জোটের রাজনীতির কিছুটা হলেও ক্ষতি হবে- এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ।

এ প্রসঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সমকালকে জানান, এটা ঠিক, তাদের দুই দলের নতুন রাজনৈতিক মঞ্চে যুক্ত হওয়া নিয়ে বাম জোটে সুস্পষ্ট টানাপোড়েন ও মতপার্থক্য রয়েছে। বাম জোটের শরিক দলগুলোর এ বিষয়ে প্রবল আপত্তিও রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ ধরনের ঐক্যের ইতিহাস আগেও হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থাকতে এই ফ্রন্ট টিকিয়ে রেখেই ১১ দল গঠন করা হয়েছিল। তাই বাম জোটকে রেখেই তারা অপরাপর গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নিয়ে আলাদাভাবে নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ার এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। যদিও বাম জোটের উল্লেখযোগ্য দলগুলো বলছে, কেবল বাম জোটেই থাকতে হবে।

ভাঙনের আশঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করছে বাম জোটের অপরাপর দলের সিদ্ধান্তের ওপর। আর বাম জোটের পরবর্তী বৈঠকেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু ঠিক হবে। নতুন রাজনৈতিক মঞ্চে যুক্ত দলগুলো বিএনপির আদর্শের অনুসারী নয়। বরং নিজ নিজ দলের আদর্শ নিয়েই কাজ করছে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক অবশ্য বাম জোটে ভাঙনের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে বলেন, 'এটা বাম জোটের সমান্তরাল বা বিকল্প কোনো জোট নয়। এটা একটা বৃহত্তর জাতীয় মঞ্চ। বিএনপিকেন্দ্রিক মেরুকরণ ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর বাইরে বাম প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক সমস্ত দল ও সামাজিক শক্তি বা অংশ এটাতে অংশ নিতেই পারে। তবে বাম জোটের বন্ধুরা এটাতে না এলে অথবা অনেক দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ বৃহত্তর জোটের আকার নিলে তখন হয়তো আমরাও যে কোনো একটা জায়গা বেছে নেব।'