ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

ই-ল্যাপ: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ সহজ করেছে যে প্ল্যাটফর্ম

ই-ল্যাপ: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ  সহজ করেছে যে প্ল্যাটফর্ম

.

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:০৬

ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রাহকদের জন্য অনেক সময় নানাবিধ কাগজপত্রের জটিল গোলকধাঁধার মতো মনে হতে পারে। ব্যবসায়ের মালিক এবং উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক সময় এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এখানে কাগজপত্র জমা, রিলেশনশিপ অফিসারদের বারবার স্বাক্ষর নিতে আসা এবং অন্য অনেক প্রক্রিয়া শেষ করতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এ সমস্যার একটি যুগোপযোগী সমাধান রয়েছে  ব্র্যাক ব্যাংকের। 
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে ব্র্যাক ব্যাংক চালু করে ইলেকট্রনিক লোন অ্যাপ্লিকেশন প্রপোজাল বা ই-ল্যাপ। এটি ঋণ প্রক্রিয়া দ্রুত এবং অধিক কার্যকর করে তোলার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দেশব্যাপী ৫৫৬টি এসএমই ইউনিট অফিসে ই-ল্যাপ চালু করা হলে বাংলাদেশের এসএমই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়।
ই-ল্যাপ চালু হওয়ার আগে ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া ছিল অনেক ধাপে বিভক্ত। ঋণ আবেদন গ্রহণ থেকে শুরু করে ঋণ অনুমোদন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই ম্যানুয়াল ডেটা এন্ট্রি ও ডকুমেন্ট হ্যান্ডলিংয়ের প্রয়োজন হতো, যা ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং এখানে ভুল হওয়ার প্রবণতাও ছিল অনেক বেশি। বিষয়টি মাথায় রেখেই ব্র্যাক ব্যাংক চালু করে ই-ল্যাপ। ভিফিন সল্যুশনস লিমিটেডের তৈরি প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করা খুবই সহজ। রেগুলেশন সম্পূর্ণরূপে মেনে চলার পাশাপাশি ই-ল্যাপ বিভিন্ন স্তরের প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী একটি প্ল্যাটফর্ম।
ডকুমেন্ট হ্যান্ডলিং এবং বিভিন্ন স্তরের অনুমোদনের কারণে আগে এসএমই ঋণের আবেদন প্রক্রিয়া শেষ হতে গড়ে ১৫ কর্মদিবসের প্রয়োজন হতো। তবে ই-ল্যাপ চালু হওয়ার ফলে এ সময় কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ দিনে। কারণ, এখন আগের চেয়ে দ্রুততর সময়ে যাচাই-বাছাই ও অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। ডকুমেন্ট হ্যান্ডলিং আগের চেয়ে আরও সহজ হয়েছে। এখন ঋণ আবেদন জমা দেওয়া যায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ফলে শুধু চূড়ান্ত ধাপে আবেদনকারীকে স্বাক্ষরের জন্য উপস্থিত হতে হয়। এটি কাগজপত্রের ঝামেলা কমিয়েছে এবং রিলেশনশিপ অফিসারদেরও বারবার ভিজিটের প্রয়োজন হয় না।
রিয়েল টাইম ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা উল্লেখযোগ্য বেড়েছে। ই-ল্যাপ সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রতিটি ঋণ আবেদনের বর্তমান অবস্থা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম এবং আবেদন কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, যা জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুরো প্রক্রিয়ায় গতিশীলতাও বাড়িয়েছে। আগে করা আবেদনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারে ই-ল্যাপের সিস্টেম ইনকোয়্যারি ফিচার। ফলে ম্যানুয়াল এন্ট্রির প্রয়োজন হয় না। মোবাইল ডিভাইস থেকেও ই-ল্যাপে লগইন করা যায়। ফলে রিলেশনশিপ অফিসার ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজাররা যে কোনো স্থান থেকে গ্রাহকদের সেবা দিতে পারেন। ব্র্যাক ব্যাংক ইতোমধ্যে ২ হাজার ২৩৭ জন ফিল্ড কর্মকর্তাকে ইলেকট্রনিক ট্যাবলেট দিয়েছে, যাতে তারা যে কোনো স্থান থেকে গ্রাহকদের উন্নতমানের সেবা দিতে পারেন।
ই-ল্যাপের প্রভাব বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী। এটি ৫৫৬টি এসএমই ইউনিট অফিস ও লোন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ৩ হাজার ৭০০-এরও অধিক ব্র্যাক ব্যাংক কর্মীকে সহায়তা করছে। ই-ল্যাপ শুধু সময়ই নয়, উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যয়ও কমিয়েছে। মোট টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম (টিএটি) দুই দিন এবং কাস্টমার সার্ভিস টাইম ছয় দিন কমার পাশাপাশি প্রত্যেক কর্মীর বছরে কমপক্ষে ১০ দিন সময় সাশ্রয় হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ই-ল্যাপ অনবোর্ডিং খরচে ৫ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা এবং কুরিয়ার খরচ ২৫ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছে।
কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ফলে ই-ল্যাপের কার্যকারিতা আরও বেড়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ই-ল্যাপকে কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত করে, যা ইএমআই ক্যালকুলেশন এবং ফান্ড ডিজবার্সমেন্টের মতো কাজগুলোর প্রসেসিং রিয়েল টাইমে নিয়ে এসেছে। এ সংযোগ স্থাপনের ফলে আগে ম্যানুয়াল ক্যালকুলেশনের কারণে যে সময় ব্যয় হতো, তা পুরোপুরি দূর করার মাধ্যমে লোন ডিজবার্সমেন্টকে আরও দ্রুত এবং ঝামেলাহীন করেছে ই-ল্যাপ।
ই-ল্যাপ শুধু একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নয়, এটি বাংলাদেশের এসএমই ব্যাংকিং খাতে একটি বড় বিপ্লবও। এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১ লাখের বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যার মোট পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের ‘মিসিং মিডল’-এর উন্নয়ন। তাঁর ভিশনকে সামনে রেখে ই-ল্যাপকে কাজে লাগিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক দেশের আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত ও উপেক্ষিত ব্যবসাগুলোকে আরও বড় পরিসরে সহায়তা করতে পারছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ফেলছে ইতিবাচক প্রভাব।

আরও পড়ুন

×