ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

হেপাটাইটিস নির্মূলে নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ

হেপাটাইটিস নির্মূলে নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ

সমকাল কার্যালয়ে রোববার ‘ হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ-সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৩ | ০৬:১২

হেপাটাইটিস রোগ ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মূলের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে অংশীজন নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি অর্থ বরাদ্দ জরুরি। রোগ নির্মূলের চেয়ে প্রতিরোধই সহজ। তাই প্রতিরোধে সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। চিকিৎসার জন্য রোডম্যাপ প্রয়োজন। মফস্বল পর্যায়ে এ রোগের পরীক্ষা, টিকাদান এবং ওষুধ সহজলভ্য করে চিকিৎসা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।

গতকাল রোববার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে ‘হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। ২৮ জুলাই দিবসটি পালিত হবে। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না’। গোলটেবিলের আয়োজন করেছে ‘ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার’ ও সমকাল। সহযোগিতায় ছিল বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস।

এতে আলোচকরা বলেন, এ রোগ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মকৌশল ও আইন প্রণয়নে অংশীজনের মতামত শুনতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে একক প্রোগ্রাম নেওয়ার পাশাপাশি হেপাটোলজিস্টদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশু জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে হেপাটাইটিস নির্মূলে সচেতনতার পাশাপাশি জনগণের দোরগোড়ায় চিকিৎসার ব্যবস্থা পৌঁছাতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসএমএমইউর ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব।

মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর এ রোগে মারা যায় প্রায় ২২ হাজার মানুষ। মহামারি করোনার মধ্যে এটি প্রকট হয়েছে। তিনি বলেন, এ রোগে আক্রান্ত ৫ শতাংশ মানুষ জানেই না যে তারা লিভারের এ রোগে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা, সস্তায় ওষুধ আর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ জরুরি।

ডা. মামুন জানান, গত পাঁচ বছরে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে হেপাটাইটিস-বির সংক্রমণ ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশীয় বিশেষজ্ঞরা ন্যাসভ্যাক নামে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের একটি নতুন ইমিউনোথেরাপি আবিষ্কার করেছেন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে ওষুধটি শিগগির বাজারে আসছে। 

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হেপাটাইটিস প্রতিরোধে এমডি হেপাটোলজিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি দেওয়া হয়। এবারই প্রথম এখানে ইন্টারভেনশন হেপাটোলজি চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের জনগণের তুলনায় হেপাটোলজিস্টের সংখ্যা অনেক কম। সরকারকে টার্গেট দিতে হবে কতজন হেপাটোলজিস্ট দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি লাখ জনগণের জন্য একজন হেপাটোলজিস্ট দরকার। আমাদের ১৬ কোটি জনসংখ্যার জন্য  দরকার ১ হাজার ৬০০ জন। কিন্তু আমাদের দেশে হেপাটোলজিস্টের সংখ্যা ১১০। এ সংখ্যা পূরণ করতে ২০৩০ পর্যন্ত সময় লাগবে।

তিনি বলেন, প্রতিদিন আমাদের দেশের বহু মানুষ শুধু লিভার সিরোসিসে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যায়। দেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে ২০ লাখ টাকা খরচ হয়। দেশের বাইরে করতে খরচ প্রায় এক কোটি টাকা। এ অবস্থা পরিবর্তনে আমাদের অবকাঠামোগতসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এরই মধ্যে সরকার নার্বাজকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনজনের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছে। তারা লিভার  ট্রান্সপ্লান্টের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি, অবকাঠামা নির্মাণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। এতে দেশের মানুষের চিকিৎসা খরচ অনেক কমে আসবে। আমাদের আগের কালোমেঘ, অর্জুন, চিরতা এসব ভেষজ ওষুধের চিকিৎসাও ফিরিয়ে আনতে হবে। এসব ভেষজ ওষুধ ইমিউনিটি বাড়ায়। 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. জামালউদ্দিন চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার টাঙ্গাইলের ১০টি উপজেলা ও মানিকগঞ্জ জেলাকে পাইলট স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের আওতায় এনেছে। সেখানে একটি গরিব পরিবার বছরে ৫০ হাজার টাকার চিকিৎসা বিনামূল্যে পাবে। এর পরিধি আরও বাড়ানো যেত। তবে কভিডের ধাক্কা আমাদের গতি কমিয়ে দিয়েছে।

শহীদজায়া শিক্ষাবিদ শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বলেন, রোগ নিয়ে অনেক গবেষণা ও ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে; কিন্তু আমাদের আগে জানতে হবে, কী করলে আমরা হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত হবো না। এসব জানা থাকলে এ রোগ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এইডস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, পানিবাহিত রোগ এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলা হয়েছে। সরকার এসডিজি অর্জনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগ এবং সি-এর কার্যকর চিকিৎসা আছে। তাই হেপাটাইটিস-বি নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক ও জাতীয় কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। দেশে হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য পৃথক জাতীয় প্রোগ্রাম না থাকা, পর্যাপ্ত জনবল ও অর্থের অভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদান বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

তিনি জানান, সরকার ইতোমধ্যে খসড়া কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছে এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে হেপাইটাইটিস-বি ও সি সংক্রমণের হার নির্ণয়ে জাতীয় জরিপ করা হয়েছে। দেশের অভিজ্ঞ হেপাটোলজিস্টদের মাধ্যমে প্রতিবছর চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশে টিকা প্রদান ও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ সহজলভ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সর্বোপরি হেপাটাইটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে।

জাপানের এহিম ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং রিসার্চার ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর বলেন, হেপাটাইটিস কখনও নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে আমরা এটি প্রতিরোধ করতে পারি। উন্নত বিশ্বে প্রতিটি ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস আছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। আবার বিশ্বের অনেক দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে অন্য দেশ থেকে কর্মী নেওয়ার সময় হেপাটাইটিস আছে কিনা তা পরীক্ষা করে। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনেককে বিদেশ যাওয়া ও চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চাকরি করতে কোনো অসুবিধা নেই।

বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মাহমুদুল হক পল্লব বলেন, দেশে আরও ওষুধ কোম্পানি থাকলেও আমাদের কোম্পানিই শুধু ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন করে। বর্তমানে বীকন থেকে লাং ক্যান্সার ও হেপাটাইটিস বি-এর ওষুধ নিউজিল্যান্ডে রপ্তানির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এবারের বাজেটে ক্যান্সারের ওষুধের ওপর সব ধরনের ভ্যাট ও ট্যাক্স তুলে নেওয়া হয়েছে। এতে দাম অনেক কমবে। তবে হেপাটাইটিস-সি রোগের ওষুধ ভ্যাটমুক্ত করলেও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হেপাটাইটিস-বির ওষুধে ভ্যাট ও ট্যাক্স তুলে নেওয়া হয়নি। সরকার উদ্যোগ নিলে হেপাটাইটিস-বির ওষুধের দামও কমানো সম্ভব। 

রোটারি ইন্টারন্যাশনালের ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর রোটারিয়ান আশরাফুজ্জামান নান্নু বলেন, আমরা স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে কাজ করি। কিন্তু এ পর্যন্ত সরকারের কোনো পক্ষ হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে কাজ করার আমন্ত্রণ জানায়নি। তার পরও আমরা এরই মধ্যে এক লাখ মানুষকে পরীক্ষা ও ১০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার কর্মসূচি হতে নিয়েছি। আমাদের ১৫ হাজার রোটারিয়ানকে সরকারের প্রোগ্রামে যুক্ত করলে আমরা সহযোগিতা করতে পারব। তিনি বলেন, দেশে হেপাটাইটিস পরীক্ষা এবং টিকার দাম অনেক বেশি। এসব প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম কমিয়ে আনলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা ও টিকার আওতায় আনা সম্ভব।

রোটারি ইন্টারন্যাশনালের ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নিমিনি রোটারিয়ান শহিদুল বারি বলেন, হেপাটাইটিস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি নির্মূল করতে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তারা ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে ভূমিকা রাখছেন বলে জানান তিনি।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক লোটন একরাম। তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি অর্থ বরাদ্দ জরুরি। এ রোগ নির্মূলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আইন প্রণয়নে অংশীজনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শিশুর জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি রোগটি নির্মূলে এর পরীক্ষা, টিকা ও ওষুধের দাম কমাতে হবে।

আরও পড়ুন

×