- মুক্তমঞ্চ
- আমেরিকান সমাজে বিপজ্জনক বিভক্তি দেখা দিয়েছে
মুক্তমঞ্চ
সাক্ষাৎকার: বারাক ওবামা
আমেরিকান সমাজে বিপজ্জনক বিভক্তি দেখা দিয়েছে
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০ । ০০:০০
আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০ । ০৩:০১
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০ । ০০:০০ । আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০ । ০৩:০১
বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনের পর প্রথম তিনি সিবিএস নিউজে এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন সাংবাদিক স্কট পেলি। দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ ভাষান্তর করেছেন মাহফুজুর রহমান মানিক
স্কট পেলি: এ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
বারাক ওবামা: দেখুন, প্রেসিডেন্ট হলেন জনসেবক। নিয়ম অনুযায়ী তাদের সময় সীমিত। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আপনি চলে যাবেন। আপনার ব্যক্তিগত ইগো, আগ্রহ কিংবা হতাশার বাইরে গিয়ে আপনাকে দেশের স্বার্থ আগে চিন্তা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আমার পরামর্শ হলো- যদি আপনি মনে করেন, আপনার শেষ কর্ম দ্বারা মানুষ আপনাকে স্মরণ করুক, যে দেশকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছে, তাহলে আপনাকে সেটাই করতে হবে।
স্কট পেলি: তার মানে আপনি বলছেন, তাকে নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে চলে যাওয়া উচিত?
বারাক ওবামা: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি তো মনে করি, তাকে নির্বাচনের পরদিন কিংবা দু'দিনের মধ্যেই তার ফল মেনে নেওয়া উচিত ছিল। আপনি যদি নিরপেক্ষভাবে সংখ্যার বিচার করেন, দেখা যাচ্ছিল জো বাইডেন সহজেই জিতে যাচ্ছেন। যেসব রাজ্যে নির্বাচনের ফল বাকি ছিল, তাতে নির্বাচনের উল্টো ফল হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। স্বীকার করার চেয়েও বড় বিষয়, ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস পরবর্তী প্রশাসনের জন্য সাধারণ ফান্ড ও সুবিধাদি আরও কমিয়ে দিচ্ছে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন জাতীয় নিরাপত্তার গোপন সারসংক্ষেপ পাচ্ছেন না। অথচ ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তা পেতেন।
স্কট পেলি: এ অবস্থায় আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া, চীন কী ভাবছে বলে আপনার ধারণা।
বারাক ওবামা: দেখুন, আমি মনে করি, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেবল এই নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থাই দেখছে না; বরং কয়েক বছর ধরেই আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে। আমাদের রাজনীতিতে যে ফাটল ধরেছে, তারা হয়তো এর সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে। একটা প্রবাদ আছে, পানির কিনারায় থাকতেই দলীয় রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। আর বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। কারণ, এই আমেরিকা মানে যুক্তরাষ্ট্র, বিভক্ত রাষ্ট্র নয়।
স্কট পেলি: আপনি বইতে লিখেছেন, 'আমাদের গণতন্ত্র মনে হচ্ছে সংকটে খাদের কিনারে'- এ দ্বারা আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
বারাক ওবামা: আমরা একটি সময় অতিক্রম করেছি, যখন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এর আগে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা যেমনভাবে প্রেসিডেন্টকে গ্রহণ করতেন, সেটার ব্যত্যয় ঘটেছে। এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিব্রতকর বিষয় হলো, আমরা দেখেছি যাকে অনেকে বলেছেন- সত্যচ্যুতি ঘটেছে। আর সেটা ত্বরান্বিত করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার ক্ষেত্রে কেবল সত্য বলা হয়নি, বলা যাবে না; বরং বলা যাবে, সত্যকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
স্কট পেলি: এ মুহূর্তে নির্বাচনের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত যে প্রতারণা দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো কী?
বারাক ওবামা: বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশা হারাতে চান না এবং কখনও পরাজয় স্বীকার করেন না। আমি অন্য রিপাবলিকানদের ব্যাপারে অধিক অস্বস্তি বোধ করি, যারা এসব বিষয় আরও স্পষ্টভাবে জানেন এবং এসব বিষয়ে তার সঙ্গে হাস্যরস হিসেবে উড়িয়ে দেন। এটি কেবল পরবর্তী জো বাইডেন প্রশাসনের প্রতিই নয়, বরং গণতন্ত্রের প্রতিও অনাস্থা। আর এটা হলো ভয়ংকর পথ। পৃথিবীব্যাপী স্বৈরশাসকরা চিন্তা করতে পারে- ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারি। মানুষ মারতে পারি। জেলে ভরতে পারি। ভুয়া নির্বাচন করতে পারি। এমনকি সাংবাদিকদের নির্যাতন করতে পারি। কিন্তু তা হওয়ার নয়। আমি মনে করি, জো বাইডেনকে বিশ্বের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে যে যেহেতু আমরা এখনও বেঁচে আছি, আমরা যে নৈতিকতার প্রচার করছি এবং আমরা যে বিশ্বাস করি, তাতে এটা হতে পারে না।
স্কট পেলি: নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তারপরও কিন্তু এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান নয়। তিনি সাত কোটি ১০ লাখ ভোট পেয়েছেন। ২০১৬ সালে যে ভোট পেয়েছেন, তা থেকেও ৮০ লাখ বেশি। এটি আসলে আমাদের দেশ সম্পর্কে কী বার্তা দিচ্ছে?
বারাক ওবামা: হ্যাঁ। এটি বলছে, আমরা খুবই বিভক্ত। কেবল রাজনীতিবিদরাই নয়, মানুষও বিভক্ত। এখন যে কোনো বিষয়ে, নীতিতে আমরা এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখব; যেখানে একজন আরেকজনকে পেছনে ফেলতে চায়। আমি মনে করি, বর্তমান মিডিয়ার পরিবেশও এ ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। এই গণতন্ত্র কাজ করবে না, যদি আমাদের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক না থকে। যদি না আমরা দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে না পারি। যারা প্রেসিডেন্ট সঠিক কাজ না করলে তাকে ভুল ধরিয়ে দিতে ইচ্ছুক।
স্কট পেলি: আমরা কীভাবে এ অবস্থা মোকাবিলা করতে পারি?
বারাক ওবামা: প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য আর কোনো আমেরিকান ব্যক্তিত্ব আমি দেখি না। কিন্তু তিনিও নিহত হন গৃহযুদ্ধের জের ধরে। আমার ধারণা, ওই অঘটন আমরা এড়াতে পারতাম। আমি মনে করি, নতুন প্রেসিডেন্ট একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। সেটাই যে কেবল ওয়াশিংটনে সব সমস্যার সমাধান করবে, তা নয়। এ জন্য আমাদের মিডিয়া ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করতে হবে। যাতে করে মানুষকে আজগুবি গল্প আর সত্যের মধ্যকার পার্থক্য ঠিক দেখানো যায়। এ জন্য আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে, মেয়র, কাউন্টি কমিশনারদের সঙ্গে কাজ শুরু করবেন। কারণ, তারাই আসল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মানে কাউকে বাদ দেওয়া নয়। বরং এটা এ রকম যে, আমাদের এই রাস্তা ঠিক করতে হবে। আমাদের এই বরফ দূর করতে হবে। এবং আমাদের বাচ্চাদের খেলার জন্য একটি নিরাপদ মাঠ তৈরি করতে হবে। এভাবে কাজ করে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সামাজিক বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে হবে।
স্কট পেলি: পরবর্তী প্রেসিডেন্টের অভিষেকের দিনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কী করা উচিত?
বারাক ওবামা: দেখুন, ক্ষমতা শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ঐতিহ্য রয়েছে। বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানান। তিনি সরকার ও এজেন্সিগুলোকে নতুন প্রেসিডেন্টকে সহায়তা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ওভাল অফিসে আমন্ত্রণ জানান। অভিষেকের দিন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান, সেখানে ছোটখাটো অভ্যর্থনার ব্যবস্থা হয়। অভিষেকে নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করেন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট দর্শক সারিতে বসেন। তিনি সাধারণ নাগরিকের মতো হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পও তা-ই করবেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। যদিও তার মনোভাব অন্যরকম। তবে আপনি জানেন, প্রত্যাশার ফোয়ারা অফুরন্ত।
স্কট পেলি: আপনার কি মনে হয়, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা যদি সমঝোতায় না যায়?
বারাক ওবামা: মিডিয়ার দৃশ্যপট বদলে গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ভোটারদের ধারণাও পাল্টেছে। তাই আমার মনে হয়, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান ভোটাররা এখন আরও বেশি পক্ষভুক্ত হয়ে গেছে। আমরা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে রিপাবলিকানদের কাছ থেকে আমি প্রায়ই শুনতাম, যারা আমার সহকর্মী ছিল। আমি সিনেটে দায়িত্ব পালন করেছি। তাদের অনেকে বন্ধুও ছিল বটে। তারা আমার কাছে বলত, দেখুন প্রেসিডেন্ট আমি জানি যে, আপনি সঠিক। কিন্তু আমি যদি এ বিষয়ে আপনাকে ভোট দিই, আমি শেষ হয়ে যাব। আমি আমার আসন হারাব। কারণ, তাদের ভোটারকে এমনই তথ্য দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে আমাকে অপরাধী বানানো হয়েছে। আমার স্বাস্থ্যবীমাকে অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এমনকি যারা চায়, তাদের পক্ষেও আমাকে সহায়তা করা কঠিন। ফলে আমি কেবল বর্তমান পক্ষভুক্ত রাজনীতির বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা সামাজিক মাধ্যমকে দোষারোপ করতে পারি না। এই বিভক্তি আমার প্রেসিডেন্ট থাকাকালের শুরু থেকেই বপন করা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, তা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
মন্তব্য করুন