নারী পাচার: তদন্ত ও বিচার
প্রতিকী ছবি
সালমা আলী
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ২৩:০৬
বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারে অভাব-অনটনের কারণে সিজিল নামে এক দালালের মাধ্যমে কোনো খরচ ছাড়াই সোনিয়া (ছদ্মনাম) সৌদি আরব যান। কার্যত তাঁকে বিদেশে পাচার করা হয়। সৌদি আরব ‘হাপার বাত’ নামে এক স্থানে এক বাসায় কাজ করতেন তিনি। সেই বাসার গৃহকর্ত্রী সোনিয়াকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার কারণে ছয় মাস কাজ করার পর পাসপোর্ট সঙ্গে করে পালিয়ে যান।
চার মাস অন্য বাসায় কাজ করার পর কোনো বেতন না পাওয়ার কারণে সেখান থেকেও সোনিয়া পালিয়ে যান এবং পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। তখন সোনিয়া শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তিন মাস থাকার পর বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এবং তাঁকে একটি সেফ হোমে রাখা হয়।
সোনিয়া তাঁর পরিবারে ফিরে যেতে চান। লেখাপড়া শিখে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে চান। তবে তাঁর মামলাটি চালানোর ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন বাস্তবতা রয়েছে। তাঁর মা বয়স ১৫ বছরের পরিবর্তে ২৫ বছর দেখিয়ে সোনিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করেছেন; যা আইনের পরিপন্থি ও দুর্নীতি। সোনিয়া টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে বিএমইটির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চাকরি নিয়ে গেলেও সেখানে গিয়ে প্রতারণা ও যৌন হয়রানির শিকার হন। বয়স কম হওয়ার কারণে তাঁর ওপর হয়রানি করা অভিযুক্তদের জন্য সহজ হয়েছে।
মাকে আসামি করা হলে সোনিয়া আরও অসহায় এবং বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। সে কারণে দেশে ফিরিয়ে আনার পর আইনগত পদক্ষেপ নিতে রাজি নন তিনি। তাই বিএনডব্লিউএলএ আইনগতভাবে মোকাবিলার জন্য এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন কারণে পাচারের আসামিরা এভাবে পার পেয়ে যায়। ভিকটিমের সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় তারা নিজেরাও মামলা চালাতে আগ্রহী হন না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর মানব পাচারের হটস্পট হয়ে উঠেছে। এ তিন জেলার মতো অতিরিক্ত মানব পাচারের মামলা যেসব জেলায় রয়েছে, সেখানে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে হবে। এসব বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে সঠিক অবকাঠামো, সরঞ্জাম ও ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। সেখানে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি এসব ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অবস্থায় এসব ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের হয়রানি বা সেবা প্রাপ্তিতে বাধা তৈরি করা যাবে না।
প্রতিবছর দেশ থেকে অনেক নারী পাচার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কিশোরী-তরুণী এমনকি শিশুও রয়েছে। এসব পরিবার ও ভুক্তভোগীদের আইনগত সেবা দেয় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডিব্লিউএলএ)। দেশ থেকে নারী পাচারের সঙ্গে একটি রাঘববোয়াল চক্র জড়িত। তারা যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশি তৎপর। এর বাইরে সারাদেশে মানব পাচার চক্রের পাঁচ শতাধিক সদস্য রয়েছে। নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে যশোর সীমান্তে। গত দুই বছরে পাচার হয়ে দেশে ফেরা অন্তত ৯০০ নারীকে আইনি সহায়তা দিয়েছে বিএনডিব্লিউএলএ। এর মধ্যে কিশোরী ও তরুণী বেশি।
২০১২ সালে আমাদের দেশে মানব পাচার আইন করা হয়। বাংলাদেশ থেকে নারী, শিশু ও মানব পাচার একটা ব্যবসা; যা কিনা চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে চালানো হচ্ছে। এটা চালাচ্ছে যারা তারা দেশের বাইরে মেয়েদের যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত করার অবৈধ তৎপরতায় মদদ জোগাচ্ছে। গত দুই বছরে (২০২২ ও ২৩ সাল) দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তাদের বেশির ভাগ এখনও উদ্ধার হয়নি।
মানব পাচারের মামলা তদন্ত এবং বিচার যে হারে হচ্ছে, তা সন্তোষজনক নয়। সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারা এবং মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে আপস-মীমাংসার কারণে আসামিরা খালাস পাচ্ছে। তাই এটি থামানো যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গত বছরের নভেম্বর মাসের মানব পাচার বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর– এই ৯ মাসে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে করা ৩৩২ মামলার বিচার বিভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৬ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন, যা মোট মামলার ৯৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ১২ হাজার ২৭৯ আসামি খালাস পেয়েছেন। যে ১৬ মামলায় ৫৬ জনের শাস্তি হয়েছে, তার মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে মাত্র দু’জনের।
মানব পাচারের মামলা পুলিশের কাছে খুবই লাভজনক। তদন্ত কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী ও আসামি উভয় পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তদন্ত দীর্ঘদিন আটকে রাখেন। টিকটকের নামে ভারতে নারীদের পাচার করে আসছিল একটি চক্র। পাচারের শিকার হওয়া এক তরুণী ২০২১ সালের ৭ মে ভারত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি ১ জুন হাতিরঝিল থানায় পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে পাচারের ঘটনায় জড়িত ছিলেন ‘টিকটক হৃদয়’ নামে পরিচিত রিফাদুল ইসলাম ওরফে হৃদয় (২৬)। তিন বছর শেষ হলেও মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। অথচ একই ঘটনায় ভারতে গ্রেপ্তার আসামিদের বিচার হয়ে শাস্তিও হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি না থাকায় আসামিদের যথাযথ সাজা হচ্ছে না।
আমরা ইউএন প্রটোকলে অনুস্বাক্ষরকারী। ইউএন প্রটোকলে অনুস্বাক্ষরকারী হলে মামলার তদন্ত করতে অন্য দেশে যাওয়ায় কোনো অসুবিধা নেই। টিকটক হৃদয়ের বিরুদ্ধে ভারতে মামলা হয়েছে। সে দেশে তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ হাতিরঝিল থানা বলছে, তারা ফিরে এলে মামলাটি চালু হবে। এটা হাস্যকর। এসব বিষয় নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করা উচিত। আসামি ভারতে আছে, বাংলাদেশে সাক্ষী নিয়ে মামলা শেষ করবে– এটা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশে আসল অপরাধীরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশে শুধু ধরা পড়ছে মিডলম্যানরা। তারা তো কিছুই জানে না। তারা শুধু ভিকটিমকে পার করে দিচ্ছে। বেশির ভাগ ভিকটিম মূল অপরাধীদের নাম-ঠিকানা বলতে পারে না। মানব পাচার আইনের মামলায় ৩ শতাংশ রায় রয়েছে। এটা নিয়ে যে দেশে আমাদের ভিকটিমরা যাচ্ছেন তাদের সঙ্গে বসা উচিত। সে দেশের পুলিশ বা ইন্টারপোলকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আগে ইন্টারপোলের মিটিং হতো। এখন আর ইন্টারপোলের মিটিং হয় না। কোনো কিছুই নেই এখন। সব মিলে হচ্ছে-যাচ্ছে-করছে এভাবে চলছে। আইন থেকে শুরু করে সবই আছে কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। যে ভিকটিম সে ভিকটিমাইজই হচ্ছে। যারা অপরাধী তারা অপরাধ করেই যাচ্ছে। জবাবদিহি না থাকায় এমন হচ্ছে। জবাবদিহি না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
এখানে আরেকটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হয় না। তারা ভুক্তভোগীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আপস-মীমাংসা করে ফেলে। ফলে আসামিদের শাস্তি হয় না। তাই মানব পাচার প্রতিরোধেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা, শিক্ষা ও নারীর কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে নারীবান্ধব সমাজ গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ)