ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

আরপিও সংশোধনে ক্ষমতা বেড়েছে, ক্ষুব্ধ সিইসির দাবি

আরপিও সংশোধনে ক্ষমতা বেড়েছে, ক্ষুব্ধ সিইসির দাবি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। ফাইল ছবি

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৩ | ১৩:৫৫ | আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৩ | ১৪:২০

জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনীতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হয়নি বরং ক্ষমতা সুসংহত হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাঁর দাবি, নতুন সংশোধনী নিয়ে অহেতুক সমালোচনা হচ্ছে। ইসিকে হেয় এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই এসব সমালোচনা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন সিইসি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরপিও’র বেশ কিছু ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করেছিল ইসি। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ৪ জুলাই আরপিও সংশোধন বিলটি সংসদে পাস হয়। এ বিষয়ে কমিশনের প্রতিক্রিয়া জানাতে সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্য করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।

সংসদে বিলটি উত্থাপণ ও পাস হওয়ার পর থেকেই এই সংশোধনী নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনসহ অনেক সংগঠন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে সমালোচনা করেছে। সাবেক নির্বাচন কমিশান ড. এম সাখাওয়াত হোসেনসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও সমালোচনায় সরব ছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, ইসি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। পাশাপাশি একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে এই সংশোধনী নিয়ে। তবে নির্বাচন কমিশন ছিল পুরোপুরি নিশ্চুপ। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে এর আগে একবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেও পরে তা স্থগিত করেন সিইসি।

ইসির প্রস্তাবে কোনো নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরে অনিয়মের অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে পুরো নির্বাচনী আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা চাওয়া হয়েছিল। সদ্য পাস হওয়া সংশোধিত নতুন আরপিও অনুযায়ী ভোটের পর ফলাফল স্থগিতের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এক বা একাধিক কেন্দ্রের। পুরো নির্বাচনের ফল বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বিলটি পাসের সময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের সমালোচনার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেন, “একটি আসনে শতাধিক ভোটকেন্দ্র থাকে। দুচারটি কেন্দ্রের ‘গন্ডগোলের’ কারণে পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া অগণতান্ত্রিক।”

সোমবার সংবাদ সল্ফ্মেলনে সিইসির কাছে একাধিকবার প্রশ্ন ছিল, তফসিল ঘোষণার পরে নির্বাচনে গণ অনিয়মের পরিস্থিতি তৈরি হলে ইসি কি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? জবাবে সিইসি অনেকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি এ প্রশ্নের উত্তর দেব না, আপনি বুঝে নিজেই উত্তর দেন।’ তবে একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আইনের বাইরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ইসির আছে। ইন-হ্যারেন্ট পাওয়ার (সহজাত ক্ষমতা) রয়েছে।’

সংশোধিত আরপিওতে ‘ইলেকশন’র জায়গায় যে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপনের প্রসঙ্গ টেনে কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এটা আমরা তো বুঝি। আপনারা যা বুঝেন তা বুঝতে থাকেন। আমরা জানি, আমরা বুঝি। এটা নিয়ে আপনারা যদি চিন্তা-ভাবনা করেন, চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন।’

নতুন সংশোধনে কমিশনের ক্ষমতা আরও বেড়েছে ও সুসংহত হয়েছে-এমন দাবি করে সিইসি বলেন, ‘ভোট বন্ধে ইসির কোনো ক্ষমতা রহিত হয়নি। একটি বিধান সংশোধন নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, ইসিকে হেয় করা হচ্ছে।’

সিইসি জানান, দীর্ঘ ক’মাসে আইনটি নিয়ে নানা বক্তব্য এসেছে। তাতে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে। এই সংশোধনী নিয়ে যে ব্যাখ্যা বা মন্তব্য এসেছে তার সবগুলো সঠিক নয়। এজন্য ইসির পক্ষ থেকে স্পষ্ট করতেই এই সংবাদ সল্ফ্মেলন।

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘কমিশন বুঝে না বুঝে নিজের পায়ে নিজে কুঠার মেরেছে-এমন মন্তব্য এসেছে। গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল, ৯১ (এ) দফায় সংশোধন হয়েছে বলে কথা এসেছে। সরকার নিজের সুবিধার জন্য আইন সংশোধন করেছে। সরকার আরপিও সংশোধন ইসির প্রস্তাব মতো করেছে। ইসি তার অবস্থানকে আরও সংহত, শক্তিশালী করতেই সংশোধনগুলো চেয়েছিল, সরকার তাতে সম্মত হয়েছে, সংসদ সম্মত হয়েছে। এতে করে ইসির ক্ষমতা বর্ধিত হয়েছে। কমিশন থেকে ইসির ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে- এটাও অবান্তর কথা। ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব ইসি পাঠাতে পারে না।’

সমালোচকদের উদ্দেশ্যে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এই সংশোধনী নিয়ে অপব্যাখ্যা করাটা দুঃখজনক। জাতি একটা সুন্দর নির্বাচন চায়। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক, বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে ইসিকে হেয় করা বাঞ্ছনীয় নয়। কমিশনকে গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করলে ইসি উপকৃত হবে।’

সিইসি জানান, আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব ১১ মাস আগে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বেশ চড়াই উৎরাই পার হয়ে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। তাতে সামান্য পরিবর্তনও করেননি। ইসির মতামত নিয়েছে, বিশেষ করে ৯১ (এ) (এ) ধারা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘অনিয়মের কারণে যে কোনো পোলিং সেন্টার বা পুরো নির্বাচনী এলাকা বাতিলের বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করেছিল ইসি। সরকারের তরফে বলা হয়েছে– যেখানে প্রভাবিত হবে, যে কেন্দ্রগুলোতে বাধাগ্রস্ত হবে, সে কেন্দ্রগুলো বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হোক। এ বিষয়ে কমিশনের মতামত চেয়েছে সরকার। কমিশন তাতে সম্মত হয়ে বলেছে– এটা যৌক্তিক। এটি সম্পূর্ণ নতুন ধারা। কমিশনের প্রস্তাবে সংসদ থেকেও কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। বিল আকারে পাস হয়, এটি আইন আকারে গেজেট হয়েছে।’

সিইসি বলেন, ‘৯১ এ ধারায় কোনো পরিবর্তন হলে কমিশনের ক্ষমতা হেরফের হতো। সেখানে কিছু করা হয়নি। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারা- যেখানে পোলিং পিরিয়ডে আমরা যে কোনো একটি, দুটি কেন্দ্র বা সমস্ত কন্সটিটিউয়েন্সির আমরা বাতিল করে দিতে পারব। সে ক্ষমতা হুবহু আগের মতো রয়েছে।’

নতুন দফা (৯১(এ)(এ) সংযোজনের বিষয়ে তিনি জানান, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তার ফল সরকারিভাবে ইসির কাছে পাঠানোর পরে গেজেট করা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না। সেখানে ইসির প্রস্তাব ছিল কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তারপরও কোনো কেন্দ্র বা কোনো সংসদীয় এলাকা নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কমিশন বিষয়টি তদন্ত করতে পারবে গেজেট স্থগিত রেখে। সেখানে সংসদ বলেছে- গেজেট স্থগিত করা যাবে, তবে-পুরো সংসদীয় আসনের নির্বাচন বাতিল না করে যে যে কেন্দ্রে ফলাফল বাধাগ্রস্ত হয়েছে মনে করবে সেসব কেন্দ্রে ফলাফল বাতিল করা যাবে বলে জানান সিইসি।

৯১ এ ধারায় ইলেকশন শব্দের পরিবর্তে পোলিং শব্দ ব্যবহারে ভোটে ইসির ক্ষমতা কমেছে বলে নির্বাচন বিশ্লেষকদের সমালোচনার জবাবে সিইসি বলেন, “এটা অপব্যাখ্যা। কমিশন তিনটি জায়গায় ‘ইলেকশন’ শব্দটাকে ‘পোলিং’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে। এটা হচ্ছে মুদ্রণজনিত সংশোধন। কারেকশন আর অ্যামেন্ডমেন্ডের মধ্যে ফারাক রয়েছে। অ্যামেন্ডমেন্ডের মধ্যে নীতিগত এলিমেন্ট থাকে, কারেকশনটা হচ্ছে জাস্ট সংশোধন। এটাকে নিয়ে অপব্যাখ্যা করাটা দুঃখজনক মনে করি।’ সাবেক এই আইন সচিব বলেন, ‘আমরা আপনাদের চেয়ে ভালো বোঝার কথা। আমরা সুচিন্তিতভাবে এটা কারেকশন করেছি।’ 

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘অপব্যাখ্যা দুঃখজনক। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার জন্য কাজ করব এটা অবান্তর মন্তব্য। কমিশন ভুল করতে পারে কিন্ত নিজের পায়ে কুড়াল মারেনি। কিন্তু এটাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা সঠিক না।’

সিইসি বলেন, ‘সরকার কমিশনকে সম্মান করেছে। ইসির প্রস্তাবিত সংশোধনে সম্মত নাও হতে পারত। ইসির প্রস্তাবে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। কমিশনের প্রস্তাব পাস হয়েছে।’

ভোটের আগে নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কি ব্যবস্থা নেবেন- এমন প্রশেুর জবাবে সিইসি বলেন, ‘নতুন আইনটা হয়নি, এটা ছুড়ে ফেলে দেন। ভোটের আগে এরকম পরিবেশ হলে আমরা কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেব।’

সিইসি বলেন, ‘আইনের বাইরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ইসির আছে। এখানে ইনহ্যারেন্ট পাওয়ার রয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে আইন-কানুন, রুলিং অনুযায়ী।’

সিইসি আরও বলেন, ‘পোলিং’ ‘ইলেকশন’ শব্দের কারণে কোনো হেরফের হবে না। বিদ্যমান বিধান দিয়েই প্রার্থিতা বাতিল করা যাবে। কখনো প্রার্থীর মৃত্যু হলে পুরো আসন বাতিল করে নির্বাচন দিতে হয়। যেকোনো পর্যায়ে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে ইসি।’

আরও পড়ুন

×