ঢাকা বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনায় ঠকছেন চরের কৃষক

দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনায় ঠকছেন চরের কৃষক

হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাট এলাকা (ফাইল ফটো)

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৩ | ০৫:২১

নোয়াখালীর দক্ষিণের চরাঞ্চল রূপ বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক পাশে ভাঙছে, আরেক পাশে জেগে উঠছে। মেঘনার উত্তাল জলরাশিতে ২০ বছর আগে গড়ে ওঠে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বয়ারচর। এখানে একসময়ের অনাবাদি জমিতে এখন ফসলের সমারোহ। শিম, শসা, বরবটি, করলা, লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, পটোলসহ নানা জাতের ফসল ফলছে এই নোনামাটির চারদিকে। তবে দুর্বল বিপণন ব্যবস্থার কারণে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে পদে পদে ঠকছেন। পাশাপাশি অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেও তারা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।

শুধু হাতিয়ার বয়ারচর নয়, দেশের অনেক দুর্গম চরাঞ্চলের চিত্র একই। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও সরকারি সহায়তার অভাব, বড় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ না থাকা এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে চরের কৃষকদের অল্প লাভেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির (কেএসইউ) যৌথ উদ্যোগে গত বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান চারটি নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র। এসব নদীর ৫০০টির বেশি উপনদী থেকে ধীরে ধীরে বালু, পলি ও কাদামাটি জমার ফলে চরগুলো গঠিত হয়েছে। এসব চরে ধান চাষের চেয়ে তেলবীজ, চীনাবাদাম, আলু, মসলা এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষ করে বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কৃষকরা প্রতিনিয়ত এসব ফসলের উৎপাদন বাড়াচ্ছেন। তবে পণ্যের ন্যায্য দাম মিলছে না।

ফেনীর সোনাগাজীর চরাঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে নানা ফসলের চাষ হচ্ছে। কৃষক সাজেদুর রহমান জানান, সোনাগাজীর চরে ১০ বছর ধরে কৃষিকাজ করছেন তিনি। ফসল চাষ এখন ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ লাগছে। কিন্তু উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে কোনো রকমে খাওয়া-পরা চলে।

নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন চরে কৃষকের কণ্ঠে যখন হতাশার সুর, তখন যমুনার বালুচরে কৃষিবিপ্লবের জয়গান। যমুনা নদীতে জেগে ওঠা এমনই একটি চর জনপদ জামালপুরের সরিষাবাড়ীর নলসন্ধ্যা গ্রাম। গ্রামটিতে যেতে ধু-ধু বালুচরে যাতায়াতের ভরসা মোটরসাইকেল ও ঘোড়ার গাড়ি। শহরে যেতে পাড়ি দিতে হয় নদী, নৌকায় লাগে আধাঘণ্টা। অথচ দুর্গম এই চরের মাঠে এখন শোভা পাচ্ছে লাল মরিচ, ভুট্টা ও নানা সবজি। জানা গেল, কৃষিবিপ্লবের নেপথ্যে সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশ সরকার যৌথ উদ্যোগে কাজ করছে।

‘মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দ্য চরস (এমফোরসি)’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে শরীয়তপুর, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও জামালপুরের যমুনার তীরের চরাঞ্চলে। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ২০২৪ সালে শেষ হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সুইস কনটাক্ট ও বগুড়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)।

নলসন্ধ্যা গ্রামের কৃষক আসাদ সরকার বলেন, আগে আমরা ভালো বীজ, সার ও কীটনাশক চিনতাম না। গত কয়েক বছরে এমফোরসি আমাদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ভালো বীজ, সার, কীটনাশক চিনিয়েছে। একই সঙ্গে এমফোরসির লোকজনের মাধ্যমে চরে উৎপাদিত পণ্য বড় বড় কোম্পানির কাছে বিক্রির সুযোগ হয়েছে। ফলে কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছেন।

আরডিএর যুগ্ম পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক ড. আব্দুল মজিদ প্রামাণিক বলেন, বড় উদ্যোক্তা কিংবা ব্যাপারীদের সঙ্গে সংযোগ তৈরির জন্য অধিকাংশ চরাঞ্চলে কোনো বাজার গড়ে ওঠেনি। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার নয়ারহাটে একটি বাজারের কাজ করছি; চলতি মাসেই এটি উদ্বোধন হবে। পর্যায়ক্রমে সব চরে বাজার গড়ে তোলা হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা ও বড় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কৃষকের সংযোগ করিয়ে দিলে চরে কৃষিবিপ্লব ঘটবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. আতিউর রহমান বলেন, চর নিয়ে আলাদা গবেষণা করতে হবে। এতে সেখানে বরাদ্দ দেওয়া সহজ হবে।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চরাঞ্চলের সমস্যাগুলো নিরসন করা গেলে দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আরও বেশি শক্তিশালী হবে। সে লক্ষ্যে কাজ করছি। এরই মধ্যে দুর্গম অনেক চরে কৃষিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে চাই; যাতে কৃষকরা লাভবান হন।

আরও পড়ুন

×