দেয়াল ধসে ইট পড়ে প্রাণ যায়, তবু নড়ে না টনক

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার নোয়াগাঁও চৌমুহনীতে সোমবার ভবনের দেয়াল ধসে ক্ষতিগ্রস্ত নূর আইডিয়াল স্কুলের কক্ষ সমকাল
ইন্দ্রজিৎ সরকার
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৪ | ০০:০৮ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৪ | ০০:১০
রাজধানীতে কখনও ভবন থেকে ইট বা রড পড়ে, আবার কখনও দেয়াল ধসে প্রাণ হারানোর মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। এতে আহতও হচ্ছেন অনেকে। ঘটনার পর এ নিয়ে কিছুটা আলোচনা হলেও নেওয়া হয় না কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে এখনও অনেক বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে নিয়মকানুন না মেনে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই। এতে পথচারী ছাড়াও নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। মামলা হলেও অনেক সময় দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হয় না। অনেক মামলা টাকার বিনিময়ে আপস হয়ে যায়।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার সকালে দক্ষিণখানে নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে পাশের টিনশেড ঘরে পড়লে ঘুমন্ত বাবা-মেয়ে গুরুতর আহত হন। এর আগে চলতি মাসেই মোহাম্মদপুরে এমন আরেকটি ঘটনায় প্রাণ যায় এক নারীর, আহত হন আটজন। গত ১৭ মে বাসাবো এলাকায় নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন থেকে পড়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সাড়ে চার মাস আগে মৌচাক মার্কেট এলাকায় মাথায় ইট (কংক্রিটের ব্লক) পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা দীপু সানা ওরফে দীপান্বিতা প্রাণ হারান। সেটি দুর্ঘটনা নাকি তাঁকে লক্ষ্য করে কেউ ইটটি ছুড়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক সমকালকে বলেন, কোথাও ‘সেফটি স্ট্যান্ডার্ড’ মেনে চলা হয় না। যাদের এটা দেখার কথা, সেই দায়িত্বশীলরাও ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এসব এড়িয়ে যান। এর মূল কারণ, দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো এমন পর্যায়ে চলে গেছে, সবাই জানে কারও কিছু হবে না। ভবন নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তা সরঞ্জামও রাখা হয় না।
তিনি বলেন, প্রতিটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেগুলো না থাকলে দায়িত্বশীলরা গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেবেন। এই সংস্কৃতি গড়ে তোলা না হলে সেটা স্মার্ট উন্নয়ন নয়। আমাদের প্রতিটি পর্যায়ে সুশাসনের ঘাটতি আছে, দায়বদ্ধতার ঘাটতি আছে। প্রত্যেক ঘটনায় নিচের ধাপের কাঁধে দায় যাচ্ছে। কিন্তু এটা অন্য কোথাও হলে প্রথমেই নজর যেত ওপরের দিকে। প্রকল্প পরিচালক, পরামর্শককে দায়ী করা হতো। উন্নয়ন হতে হবে নিরাপদ। এ বিষয়ে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।
দীপু সানার মৃত্যুর কিনারা হয়নি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট শাখায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৩৭ বছরের দীপু সানা। গত ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে মৌচাক মার্কেট এলাকায় মাথায় ইট পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস জানান, প্রকৃতপক্ষে সেদিন কী ঘটেছিল, তা জানার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন স্থানের সিসিটিভি ক্যামেরার বিপুল পরিমাণ ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে এখনও কোনো বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মোহাম্মদপুরে নারীর মৃত্যুতে হয়নি মামলা
গত ৫ মে রাতে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় নির্মাণাধীন ১৬ তলা ভবনের দেয়াল ধসে পড়ে পাশের একটি টিনশেড বাড়ির ওপর। এতে রেশমা আক্তার (৪০) নামে এক নারী নিহত হন। আহত হন ওই বাড়িতে বসবাস করা আটজন। এ ঘটনায় দায়ীদের আইনের আওতায় আনা দূরের কথা, কোনো মামলাই হয়নি।
পুলিশের মোহাম্মদপুর অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, নিহতের স্বজনকে মামলা করতে বলেছিল পুলিশ। তবে তারা রাজি হননি। আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।
এর আগে ৬ এপ্রিল রাতে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদ রোডে ভবনের কলাম ভেঙে পড়ে মারা যান পথচারী মো. হাসান। ওই ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ এবং ৫০-৫৫ জনকে অজ্ঞাত পরিচয় আসামি হিসেবে মামলা করা হয়। মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক জানান, পরদিনই সব আসামি জামিন পেয়েছেন।
অবহেলায় তিন শ্রমিকের মৃত্যু
বাসাবো এলাকায় গত ১৭ মে নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন থেকে পড়ে তিন শ্রমিক মারা যান। তারা হলেন– আলতাফ হোসেন (৪০), অন্তর (২৫) ও মফিজুল ইসলাম (২০)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত নকশা না মেনে এবং উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভবনটি নির্মাণ চলছিল। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না। আসামিরা গ্রেপ্তারের আগেই জামিন পেয়েছেন।
সবুজবাগ থানার ওসি প্রলয় কুমার সাহা বলেন, অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে ভবন মালিক ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আসামিরা জামিনে রয়েছেন। মৃতদের পরিবার ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে বিবাদীদের সঙ্গে আপস করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
- বিষয় :
- দেয়াল ধসে মৃত্যু