ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

বিজয় সরেজমিন

বিজয়ী ছাত্ররাই আজ দেশের শিক্ষক

বিজয়ী ছাত্ররাই আজ দেশের শিক্ষক

তেজগাঁওয়ে সোমবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে নতুন সরকারের রূপরেখা ঘোষণার কথা জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা - সমকাল

ফারুক ওয়াসিফ

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪ | ০১:৩৬ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২৪ | ১৪:০০

দুপুর ঠিক ২টা বাজে। খবর এলো, ছররা গুলি হয়েছে সায়েন্স ল্যাব, শ্যামলী, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, শহীদ মিনারসহ আরও কিছু জায়গায়। ছাত্র-জনতার স্রোত সেসব ভাসিয়ে ততক্ষণে বাংলামটর পেরোচ্ছে। এখন তারা কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার সামনে। সেখান থেকেই দেখা গেল, ফার্মগেটের দিক থেকেও একটা মিছিল আসছে। গত রোববার বিকেলে ওখান থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা গুলি ছুড়েছিল। তাই কয়েক মুহূর্তের উত্তেজনা-ভয়। একটা থম ধরা ভাব। ফার্মগেটের মিছিলটা তখনও আসছে। আরেকটু এগিয়ে আসতেই সার্ক ফোয়ারার ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে উঠল। ফার্মগেটের মিছিলটাও তো তাদেরই।

এই দৃশ্য অদ্ভুত, দু’দিকের দুই জনস্রোত বুকে বুক মেলাতে ছুটে আসছে। ঠিক সে সময় বাংলাদেশ এক হচ্ছে রাজপথে। তাদের লক্ষ্য গণভবন। ঠিক তখনই জানা গেল, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন।
দুপুর আড়াইটা: জনতার সংসদ চলে গেছে জনতার দখলে। গণভবনেও মানুষ আর মানুষ। সংসদের লেকে সাঁতার কাটছে একদল ছেলে। কয়েকজন হয়তো দীর্ঘদিনের জমাট ক্ষোভ থেকে এটা-ওটা ভাঙতে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের কেউ না কেউ তাদের বাধা দিচ্ছিল। বলছিল, ‘ভাই, দেশের সম্পদ নষ্ট করে কী লাভ!’ ছাত্ররা বের করে নিয়ে যাচ্ছিল উর্দিপরা ১০-১২ জনকে। বুট আছে, প্যান্ট আছে; খালি মূল ইউনিফর্মটা নাই। দুই হাত মাথার ওপরে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে তোলা। তারা সংসদের নিরাপত্তারক্ষী। তাদের গায়েও কেউ হাত তুলতে দিচ্ছিল না। একটা হেলিকপ্টার ওপরে চক্কর খাচ্ছিল। একটা কিশোরী মেয়ে সেটার দিকে আঙুল তুলে কী যেন বকাবকি করল, শোনা গেল না।

সংসদ প্লাজায় মাথায় লাল ফিতা হাতে একটা পিরিচ। তাতে লেখা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। কাঁদতে কাঁদতে যুবকটা বলছিল, ‘এইটা আমি নিলাম। আমি নির্যাতিত হইছি ২০১৮-তে। এইটা আমি বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে সারাজীবন রাখব।’ আকাশে তখনও কালো ধোঁয়া, বাতাসে পোড়া গন্ধ।

যে সংসদ জনতার হওয়ার কথা, সেই সংসদে জনতার প্রবেশাধিকার ছিল না। আজ জনতা বীরের বেশে সেখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর ছবি তুলছিল। বাবা শিশু মেয়েকে নিয়ে এসেছেন, মা এসেছেন পানির বোতল বিলাতে বিলাতে। তেজতুরীপাড়ার এক মসজিদ থেকে লম্বা পানির নল এনে রাস্তায় সবাইকে পানি খাওয়ানো চলছিল। বাংলাদেশ গত ২০ দিনে কারবালার মতো শহীদ আবু সাঈদদের রক্তে লাল হয়ে গেলেও আন্দোলনকারীদের মুখে পানি দেওয়ার মতো মীর মুগ্ধরা ছিল। জাতীয় সংসদ প্লাজাতেও তাদের দেখেছি। কিন্তু একটা আশঙ্কাও জাগল সংসদের দক্ষিণে এমপিদের ভবনগুলোর দিকে তাকিয়ে। অনেকে সেখানে ঢুকে পড়ছিল। এই প্রবণতা ভালো লক্ষণ নয়।

আমরা বিজয় দেখেছি, যখন একজন রিকশাচালক চিৎকার করতে করতে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে।’ ঢাকার সব পথ নদী হয়ে গিয়েছিল। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা সেই মুক্ত রাজপথে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিল। যে দেখেনি, সে জানবে না মুক্তির কী স্বাদ। কেননা, বিপ্লব কখনও টেলিভিশনে দেখা যায় না। ঘণ্টা দুই আগেই বিজয়ের চিহ্ন দেখেছিলাম মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ীর রাস্তায়। দেখেছি রাজাবাজারের গলিতে, দেখেছি কারফিউর ভেতর আড়ংয়ের সামনে বারবার সাইকেল নিয়ে চক্কর খাওয়া কিশোর ছেলেটির চোখে। কারফিউর ভেতরও আমাকে সে বিজয়ের ভি-চিহ্ন দেখিয়েছিল। বুকের গত গভীরে ওরা জেগেছে, কতটা মনের জোর থাকলে, দেশকে কতটা ভালোবাসলে এমন সাহস দেখা যায়! তরুণরা, তোমাদের অভিবাদন, তোমাদের সালাম। তোমাদের ঋণ শোধ হবে না।

কিন্তু তারপর কী? বিজয়ের মুহূর্তের পরেই চিন্তা আসে, বিজয় ধরে রাখা যাবে তো? নতুন কোনো চক্রান্ত আবার আমাদের ছাত্র-জনতার বিজয়কে বেহাত করার সুযোগ নেবে না তো? এই উদ্বেগটাই ছিল বীরশ্রেষ্ঠ আবদুর রউফ কলেজের ছাত্র ফাহিমের গলায়। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে সে বলছিল, ‘এই বিজয় আমাদের, আমাদের ভাইদের। খালি সরকার বদলালেই হবে না, আমরা এই দেশে স্বাধীন মানুষের মতো বাঁচতে চাই।’ এক মধ্যবয়সী লোক চিৎকার করে উঠলেন, ‘সরকার বদলায়, কিন্তু আমরা যে-ই, সে-ই হইয়া থাকি।’ মনে হলো, দেশের মালিকরা এতদিনে কথা বলতে শুরু করেছে। বিপদ পুরোপুরি না কাটলেও আশা জেগেছে।

এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে জটিল। অনেক প্রশ্ন, অনেক বিতর্ক হবে। কিন্তু লক্ষ্য ও নিশান হাতছাড়া করা যাবে না। কে নেতৃত্ব দেবে দেশকে, কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে দেশের বাস্তবতা? কেমন সংবিধান দরকার, কেমন হবে অস্থায়ী সরকারের রূপরেখা? বিজয়ের পরেই আসে এ প্রশ্নের মুহূর্ত। কারণ, প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো এই ছাত্রবিদ্রোহ, এই নাগরিক অভ্যুত্থান ঘটায়নি। যারা দেশটাকে মুক্ত করেছে, তারা পুরোনো প্রজন্মের সুবিধাবাদ, ভীরুতা, আপসকামিতা থেকে শেখেনি। তাদের শিক্ষক তারা নিজেরাই। এখন তারা জাতিরও শিক্ষক, দেশের কাণ্ডারি। যে কোনো পরিবর্তন আর পুনর্গঠনের আলোচনায় তাদের আওয়াজটাই মূল আওয়াজ। তাদের দায়িত্বশীল এবং দেশকে এক করার কথাই এখন বাংলাদেশ শুনতে চায়। ছয় ছাত্রনেতা ও তাদের সঙ্গী-সাথি কোটি কোটি ছাত্র-তরুণের রক্তে কেনা বিজয় বেহাত হতে দেওয়া যাবে না। পুরোনো ক্ষমতার ডালে মধুর চাক বেঁধে থাকা লোকেরা যেন ফায়দা তুলতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা খুব জরুরি।
এই আন্দোলন পুরোনো রাজনৈতিক মতবাদে বিভক্ত হতে রাজি না। আজকের ঢাকা সারাদেশের প্রতিচ্ছবি বুকে নিয়ে হেঁটেছে। সেই বাংলাদেশে নারী আছে, পুরুষ আছে, মুসলিম আছে, হিন্দু আছে, সমতলের মানুষ আছে, পাহাড়ের আদিবাসীও আছে। আছে ডান, আছে বাম, আছে মধ্যপন্থি কিংবা নিতান্তই গেরস্ত নিরীহ মানুষ। সময়ের প্রয়োজনে তারা দেশের ডাকে সাড়া দিয়েছে। এই বাংলাদেশ ভারতপন্থি না, চীনপন্থি না, আমেরিকাপন্থি না; তারা বাংলাদেশপন্থি। এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ সংগ্রাম শেষ করে এগিয়ে যেতে চায়। গণশত্রু ছাড়া সবারই অধিকার আছে এই নতুন বাংলাদেশে।

এগিয়ে যেতে হলে চাই বাস্তব গণতন্ত্র। কাগুজে গণতন্ত্র আমরা দেখেছি, ভোটের গণতন্ত্র আমরা দেখেছি। আমরা চাই, প্রত্যেক নাগরিকের সমতায়ন ও ক্ষমতায়নের গণতন্ত্র। কেননা গণতন্ত্রের পথেই দেশ উন্নত হয়, সমৃদ্ধশালী হয়; মানুষ পায় তার পাওনা মর্যাদা। পাশাপাশি দেশের সৈনিক ভাইয়েরা, প্রবাসী বাংলাদেশিরা, দেশের কৃষক-শ্রমিকরা, দেশের উৎপাদক-রপ্তানিকারকরা, দেশের পরীক্ষিত নাগরিকরাও অনেক কথা বলতে চান। যেমন একটি কিশোর আজ বলেছে তার বাবাকে, ‘বাবা, আমাদের কি এখনও আগের বইগুলো মুখস্থ করতে হবে?’ কথাটার ভেতর শিক্ষার কান্না শোনা যায়। শোনা যায় শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি। কেননা, শুধু শিক্ষার্থীরাই শহীদ হননি, খুন হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাটাও।

এই কিশোর-তরুণরা অবিশ্বাস্য সাহসে, অলৌকিক শহীদানে বাংলাদেশকে জাগিয়ে দিয়েছে। এই বাংলাদেশ অপরাজেয় বাংলার মতো অজেয়, এই বাংলাদেশ শহীদ মিনারের মতো বিনয়ী, এই বাংলাদেশ শহীদ আবু সাঈদের মতো বীর, এই বাংলাদেশ মীর মুগ্ধের মতো দায়িত্ববান। এই বাংলাদেশ আর পিছু ফিরবে না। রক্তের ধারা কখনও পেছনে গড়ায় না।

ফারুক ওয়াসিফ : কবি ও লেখক। সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক।

আরও পড়ুন

×