ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

লোকজীবনধারার বিচিত্র স্মারক

লোকজীবনধারার বিচিত্র স্মারক

শেখঘাটের বাঁশ-বেত পণ্যের হাট

 শিশির কুমার নাথ

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৭ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:৫৬

মানুষকে সর্বত্রই তার প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানকে কাজে লাগিয়ে জীবনযাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। সুদীর্ঘকাল থেকে এভাবেই মানুষ তার ঐতিহ্যিক জীবনধারার বৈশিষ্ট্যকে নির্মাণ করেছে। সিলেট শহরের শেখঘাট এলাকার বাঁশ-বেত পণ্যের বাজার যেন সেই লোকজীবনধারার প্রাচীন স্মারক বহন করে চলছে। নগরের কিনব্রিজসংলগ্ন এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে ৮-১০টি ঝুপড়ি দোকান। স্তরে স্তরে সাজানো বাঁশ-বেতের বাহারি পণ্য। পণ্যগুলোয় শৌখিনতার চেয়ে প্রয়োজনের দিকটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তবে প্রয়োজন ছাপিয়েও নান্দনিকতার জায়গায় কারিগররা যে খুব ঘাটতি রেখেছেন, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রতিটি বস্তুতে অজান্তেই যেন শিল্পীমনের প্রকাশ ঘটেছে।

কিনব্রিজ পেরিয়ে বাম দিকের ফুটপাত ধরে এগিয়ে যেতেই সারি সারি বাঁশ-বেতের পসরা চোখে পড়ে। সরু গলিতে প্রবেশ করতেই ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক কানে আসে। দেখামাত্রই বিক্রেতার সাগ্রহে সম্বোধন, ‘ভাই, কী লাগবে?’ ছোট্ট দোকানটির ওপরে-নিচে সব জায়গাতেই জিনিসপত্রে ঠাসা, বসার জো নেই। দাঁড়িয়ে আলাপ করলাম কিছুক্ষণ। বিক্রেতা মো. সোহেল জানান, আগের মতো বাঁশপণ্যের চাহিদা না থাকলেও একেবারে মন্দ বলা যায় না। সারাবছরই কমবেশি কেনাবেচা হয়। তবে বাজারে পণ্যের জোগান কিছুটা কম থাকায় দাম কিছুটা বাড়তি।

সোহেলের দোকানে যেসব সামগ্রী দেখা গেল, সেসবের মধ্যে রয়েছে– কুলা, ডালা, টুকরি, ঝুড়ি, চাটাই, পাটি, ধাড়া, পলো, চাঁই, সের, সাঝি, ঝাকা, কাকরাইন, চালুনি ইত্যাদি। পণ্যের আকার ও মানভেদে দাম নির্ভর করে। ৫০ থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের পণ্য রয়েছে। সাধারণ কুলা, ডালা, সের, হাতপাখা এসব পাওয়া যায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। টুকরি, ঝুড়ি, সাঝি ৫০ টাকা করে, মাছ ধরার পলো ২০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। 

এখানকার পুরোনো ব্যবসায়ীর খোঁজ করতেই জানা গেল, জসীম অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী জসীম উদ্দীনের নাম। দোকানে প্রবেশ করতেই বোঝা গেল কিছুটা ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। কাজের ফাঁকে আলাপচারিতায় উঠে এলো এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যের নানাদিক। জসীম উদ্দীনের নিজ জেলা নোয়াখালী। ১৯৮০ সাল থেকে এখানে থিতু হয়েছেন। বললেন, ‘এখানকার ব্যবসা বেশ প্রাচীন। তাঁর জানা মতে, পাকিস্তান আমল থেকেই এখানে বাঁশপণ্যের হাট বসে। নিজেরও দীর্ঘদিনের পাইকারি ব্যবসা। দৈনিক ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়। সিলেট এবং এর আশপাশের জেলা থেকে ক্রেতারা আসেন।’ একজন ক্রেতার হাতে বেশ কয়েকটি কুলা। জানতে চাইলে ক্রেতা মনোমোহন বললেন, ‘১০টি কুলার দাম পড়েছে ৯০০ টাকা। অগ্রহায়ণ মাস, ধানের মৌসুম; তাই জোগাড়যন্তর করে রাখা।’

জসীম উদ্দীন মনে করেন, এসব কাজে পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি পাওয়া যায় না। আবার প্লাস্টিক পণ্য সহজলভ্য হওয়ায় মানুষজন বাঁশ-বেতের পণ্য ব্যবহার করছে কম। পণ্যের পরিবহন খরচও বেশি। এখানকার বেশির ভাগ পণ্য আসে লামাকাজী, জৈন্তাপুর, কালীগঞ্জ, লংলা, জকিগঞ্জ, আদমপুর এসব জায়গা থেকে। তবে সেসব জায়গায় আগের মতো কারিগর নেই। অনেকেই বাধ্য হয়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছেন। 

অন্য একটি দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা বাচ্চু অ্যান্ড ব্রাদার্স। স্বত্বাধিকারী মতিন মিয়া দোকানটির সামনে সাজিয়ে রেখেছেন মাছ ধরার বড় আকারের পলো আর চাঁই। পানি কমতিতে বিলে পলো বাওয়ার একটা রেওয়াজ তো আছেই। সিলেটের বিভিন্ন হাওর ও বিলে পলো বাওয়া হয়। তাই এ সময় পলোর চাহিদা থাকে। এ ছাড়া স্তূপাকারে রাখা হয়েছে রঙিন ও সাদা শীতলপাটি। সিলেটের ঐতিহ্যিক পণ্যের কথা এলে শীতলপাটির কথাই প্রথমে আসে। তাই সব দোকানির কাছেই বাঁশপণ্যের পাশাপাশি কমবেশি শীতলপাটি রয়েছে। এসব পাটির দাম সাধারণত ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। 

বাঁশ থেকে তৈরি সামগ্রী মাছ ধরা, শস্য ঝাড়া, শুকানো ও শস্য সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়। গৃহস্থালি কাজেও বাঁশপণ্যের রয়েছে নানা ব্যবহার। তাছাড়া এ অঞ্চলে বাঁশের ভিন্নধর্মী ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। নল বাঁশ নামে পরিচিত এক ধরনের ছোট বাঁশ বড়লেখা থানায় প্রচুর জন্মায়। সেখানকার অধিবাসীরা এ বাঁশ দিয়ে হুক্কার জন্য উন্নতমানের অলংকৃত পাইপ বা নল তৈরি করতেন। 

অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির বর্ণনায়, ‘মুলি বাঁশ সাধারণ কাজে বহুল রূপে ব্যবহৃত হয়। থাং ও ডলু গৃহকাজে (চালের রুয়া ও খাপ প্রস্তুতে) ব্যবহৃত হয়। জাই ও বরুয়াতে ঘরের খুঁটি হয়। করিমগঞ্জ ও লংলা প্রভৃতি স্থানে কচি ডলু বাঁশের চোঙা কাটিয়া তন্মধ্যে বিরইন চাল ও জল ভরিয়া চোঙার মুখ বন্ধক্রমে পোড়ানো হয়। পোড়ানো হইলে চালগুলি পক্ব হইয়া একরূপে পিষ্টক প্রস্তুত হয়। সাধারণত পৌষ ও মাঘ মাসে এই পিষ্টক (পিঠা) লোকে আগ্রহের সহিত ব্যবহার করে।’ বাঁশের এমন বহুরূপী ব্যবহার আমাদের লোকায়ত জীবনধারাকে সমৃদ্ধ করেছে। শেখঘাটের বাঁশপণ্যের বাজার সেই গৌরবোজ্জ্বল ধারাকে এখনও বয়ে নিয়ে চলছে।

আরও পড়ুন

×