জ্যোৎস্নার আলোয় অন্নপূর্ণা

অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প
শাহনাজ আক্তার
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৯ | আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৪:৩৩
ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম এভারেস্ট হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। তখন থেকেই বরফ আবৃত পর্বত দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। ২০২০ সালে পর্বতারোহণ ক্লাব বাংলা মাউন্টেইনারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) সদস্য হয়েছি। সে সময় ক্লাবের ভাইয়া-আপুদের কাছে হিমালয়ের গল্প শুনে ইচ্ছেটা আরও তীব্র হয়। হঠাৎ একদিন পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল ভাই জানতে চাইলেন আমি হিমালয়ের অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে ট্র্যাকিং করতে চাই কিনা। এ সুযোগটা হাতছাড়া করি কী করে! পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে একদিন পরই তাঁকে যাওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়ে দিলাম। তারিখ ঠিক হলো ২৩ ডিসেম্বর।
সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে উঠে বসলাম। প্রথমবারের মতো বিদেশ ভ্রমণ, তাও আবার বিমানে, সেটিও প্রথমবারের মতো। বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি তুলার মতো মেঘগুলো ভেসে আছে। ঘণ্টাখানেক সময় লাগল কাঠমান্ডু পৌঁছাতে। এই ট্রিপে আমরা চারজন সদস্য বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি, লেখক ও পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল ভাই, চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম এবং আবু কাওসার ভাই। বিকেলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষ করে সন্ধ্যায় বাসে উঠে বসলাম পোখারার উদ্দেশে। ২৪ তারিখ ভোরে পৌঁছে গেলাম পোখারায়। সকালের নাশতা করার জন্য বসে আছি একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে। হঠাৎ চোখ পড়ল পর্বতচূড়ার দিকে, তুষারের চাদর গায়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের পর্বতমালা। ভোরের সূর্যের আলোয় সোনালি রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। আকাশ পরিষ্কার থাকায় এত কাছে দেখা যাচ্ছিল যে একটু হাঁটলেই বুঝি কাছে চলে যাব। এর মধ্যেই আমাদের স্থানীয় গাইড আশীষ ত্রিপাঠী চলে এসেছেন। চা-বিস্কুট খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
দুপুরের আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম ঝিনুতে। এখান থেকেই আমাদের ট্র্যাকিং শুরু। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়ল বড় এক ঝুলন্ত সেতু। পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর দুই পারের দুই পাহাড়কে এক করেছে। শাকিল ভাই ওপরের দিকে একটি লজ দেখিয়ে বললেন, নদীর ওপারে পাহাড়ের ওপর আমরা আজ দুপুরে খাবার খাব। যাত্রা শুরুর আনন্দে আমি তাড়াহুড়া করে এগিয়ে চলছি লজের দিকে। প্রথমবারের মতো এত বড় ঝুলন্ত ব্রিজ পার হচ্ছি। কিছুটা পথ ওঠার পর খেয়াল করলাম আমি অন্ধকার দেখছি চারপাশ। কেমন যেন লাগছে, সঙ্গে সঙ্গে বসে যাই রাস্তার পাশে। শাকিল পেছন থেকে দ্রুত এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা? আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে; মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুই-তিন মিনিট বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো। শাকিল ভাই তাঁর পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পানি পান করেন, ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই। এত তাড়াহুড়া করবেন না। এখন আপনি যে উচ্চতায় আছেন এমন উচ্চতায় আগে কখনও ওঠেননি। আমরা এখন অতিউচ্চতায় চলে এসেছি, আস্তে আস্তে হাঁটবেন।’ তাঁর এই কথার পর থেকে আর তাড়াহুড়া করিনি কখনও। আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। এই ভুল আর কখনও করব না।
দুপুরের খাবার শেষে আমাদের ট্র্যাকিং আবার শুরু। এখন একদম খাড়া চড়াই উঠে যেতে হবে। কচ্ছপের মতো ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম চমরং। আজকের রাত আমরা এখানেই কাটাব। বিকেলে লজের ডাইনিং রুমে আড্ডা দিয়ে আর জাহাঙ্গীর ভাইয়ের গান শুনে সময় পার করে দিলাম। আমার রুমটা ছিল এমন জায়গায়, যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাছাপুছার পর্বত দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে, কেউ সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছে। ডাইনিং রুমগুলোয় বিভিন্ন দেশের পতাকা এবং পর্বতারোহীদের বিভিন্ন পোস্টার লাগানো আছে। সবাই তাদের উপস্থিতি জানান দিতেই স্মারক হিসেবে রেখে যায়।
পরদিন আবার ট্র্যাকিং শুরু হলো। মাঝেমধ্যে চা-নাশতার বিরতি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যায় পৌঁছে যাই হিমালয় নামক লজে। আজকের মতো এখানেই রাতযাপন। লজগুলোয় সন্ধ্যার মধ্যেই খাবার শেষ করে সবাই শুয়ে পড়েন। খাবার টেবিলে দেখা হলো ভিন্ন দেশের নানা বয়সী ও বিভিন্ন পেশার মানুষজনের সঙ্গে। তারা সবাই পাহাড়ের টানে ছুটে এসেছেন হিমালয়ে। মানুষগুলো বিভিন্ন দেশের হলেও মানসিকতা, পছন্দ, অপছন্দ, ভালো লাগা, মন্দ লাগাগুলো যেন একই সুতোয় গাঁথা। হিমালয়ে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো মাইনাস তাপমাত্রায় রাত পার করছি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের দুই-তিন ডিগ্রি নিচে নেমে গেছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি, যা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
সকালে নাশতা শেষে আজকের যাত্রা শুরু। উদ্দেশ্য একেবারেই অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প। আমাদের আজকের পরিকল্পনা হলো দুপুরে আমরা মাছাপুছার বেসক্যাম্পে দুপুরের খাবার খেয়ে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে গিয়ে থাকব। মাছাপুছার বেসক্যাম্পে পৌঁছানোর পর হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একদল মেঘ এসে চারপাশ ঢেকে দিল। এমন অদ্ভুত আবহাওয়া কখনও দেখিনি। দুপুরের খাবার খেয়ে আবার রওনা দিলাম অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পের উদ্দেশে। মাছাপুছার বেসক্যাম্পের আগ থেকেই জায়গায় জায়গায় বরফ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমরা অনেক আগেই ট্রি লাইনের ওপরে চলে এসেছিলাম; যার কারণে এখানকার বাতাস ছিল অনেক পাতলা এবং প্রকৃতির অবস্থা একটু অন্যরকম। যেহেতু বড় কোনো গাছপালা নেই, তবে ছোট ছোট সোনালি বর্ণের ঘাসের চাদরে ঢাকা ছিল।
বেলা শেষে রোদ এসে পড়েছে বরফে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে। দেখে মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। সবাই আমাদের আগে চলে গেছেন। আমার সঙ্গে শুধু শাকিল ভাই আছেন। একটা সময় মনে হচ্ছিল শরীর যেন আর চলছে না। এর মধ্যে পর্বতের পেছন থেকে পুরো চাঁদ বেরিয়ে এলো। জ্যোৎস্না আমার ভীষণ পছন্দের। কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল পূর্ণিমা। বিশাল বড় থালার মতো চাঁদ যেন সাপের মাথার মণির মতো জ্বলজ্বল করছে। চারপাশে সাদা বরফের পাহাড়গুলোয় চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে তৈরি হয়েছে এক অলৌকিক পরিবেশ। যেন টাইম মেশিনে করে রূপকথার কোনো মায়ার রাজ্যে চলে এসেছি। যেন স্বর্গের একটি খণ্ড পৃথিবীতে নেমে এসেছে। আমি আর শাকিল ভাই মিনিট পাঁচেকের মতো সময় দাঁড়িয়ে থেকে শুধু এই পরিবেশ উপভোগ করেছি। কোনো কথা বলিনি, একদম চুপ।
হিমালয়ের নীরবতা আর বরফ ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাস অনুভব করছি। দূর থেকেই বেসক্যাম্পের আলো দেখা যাচ্ছে। যখন ‘নমস্তে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প’ লেখা সাইনবোর্ড দেখলাম পথের সব ক্লান্তি ভুলে গিয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম। সাইনবোর্ডের খুঁটিতে হাত রেখে আবেগে নেচে উঠলাম। এতটা নির্ভেজাল খুশির মুহূর্ত অল্পই আছে আমার জীবনে। জ্যোৎস্নার আলোয় দিনের মতোই সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমরা আমাদের লজে চলে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে যখন রুমে এলাম তখন আরও অবাক হলাম। মাথার কাছে বিশাল গ্লাস লাগানো জানালা। জ্যোৎস্নার আলো এসে ঘরময় আলোকিত। জ্যোৎস্নার আলোয় অন্নপূর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে আর চাঁদের আলোর চাদর গায়ে দিয়ে প্রশান্তির ঘুমে ডুবে গেলাম। হিমালয়ের যে অপার সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করল, তা আমি চাইলেই চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাই। এই মুগ্ধতার ঘোর থেকে আমি কখনোই বের হতে চাই না। এটি ক্ষুদ্র জীবনের স্মৃতিতে আঁকা হয়ে থাকুক জন্মদাগের মতো।