- মতামত
- ভালোবাসার পরিধি ও দেশপ্রেম
ভালোবাসার পরিধি ও দেশপ্রেম

ভালোবাসা শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক বড়। মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার ক্ষেত্রে ভালোবাসা প্রযোজ্য। এটা অনুভব করার ব্যাপার। মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোনের ভালোবাসা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। তবে স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়তে হয়। লালন করতে হয়। ভালোবাসা ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কিছু ভালোবাসা মেকি, যা শুধু মানুষকে খুশি করার জন্য প্রকাশ করা হয়; অন্তর থেকে নয়। ভালোবাসা ধর্ম, বর্ণ, সমাজ, ছোট-বড়, উঁচু-নীচু, জাত-পাত কিছুই মানে না। সত্যিকারের ভালোবাসা অকৃত্রিম।
পৃথিবীর অনেক দেশে আগে থেকেই ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান প্রথম বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালনের প্রচলন শুরু করেন। ভালোবাসা দিবসে তিনি প্রথম গোলাপ ফুল উপহার দিয়ে দিবসের প্রচলন শুরু করেন। আমরা এখন নানাভাবে এই দিবসটি পালন করি।
ভালোবাসা দিবসের শুরু কীভাবে- সে সম্পর্কে নানা গল্প প্রচলিত আছে। প্রথম গল্পটি এমন- ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন শিশু প্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপি মানুষ। তিনি খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং রোম সাম্রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোডিয়াস দেব-দেবীর পূজারি ছিলেন। সম্রাট তখন ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দেব-দেবীর পূজা করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করেন। এর ফলে সম্রাট ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মযাজককে বন্দি করেন এবং পরবর্তী সময়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই ভালোবাসার প্রেমিক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই দিবস অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
দ্বিতীয় গল্পটি প্রচলিত আছে এরকম- কারারুদ্ধ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই দেখতে আসতেন, সঙ্গে আনতেন ফুল। কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলতে আসতেন। একসময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যান। ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসার মাধ্যমে মেয়েটি একসময় তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। তরুণ-তরুণীদের প্রতি ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসা এবং ভ্যালেন্টইনের প্রতি তরুণ-তরুণীদের ভালবাসার কথা জানতে পেরে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং সেই সময় অর্থাৎ ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
তৃতীয় গল্পটি ছিল এমন- রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোডিয়াসকে তার সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে দরকার ছিল বিশাল এক সেনাবাহিনীর। এ জন্য সেনাবাহিনীতে যুবকদের যোগদান করতে বাধ্য করতে বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তৎকালীন সম্রাট ক্লোডিয়াস। তার এ ধরনের ঘোষণায় এ দেশের যুবক-যুবতীরা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনও এ নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। তিনি গোপনে তার গির্জায় বিয়ে পড়ানোর কাজ পালন করতে থাকেন। তখন তিনি পরিচিতি পেলেন 'ভালবাসার বন্ধু'। যখন ভ্যালেন্টাইনকে দেওয়া এই উপাধিটি সম্রাট ক্লোডিয়াসের কানে গেল, তখন তিনি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি সৈন্যরা ভ্যালেন্টাইনকে হাত-পা বেঁধে সম্রাটের কাছে নিয়ে হাজির করেন। তখন সম্রাট তাকে হত্যার আদেশ দেন। এরকম নানা গল্প প্রচলিত আছে ভালোবাসা দিবস উদযাপনের পেছনে।
মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। ফলে এই ভালোবাসা থেকেই ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি। ভালোবাসা মানুষের হৃদয়ে, অন্তরে, চিত্তে, মননে বিরাজ করে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে ভালোবাসার জন্ম হয়। এই ভালোবাসা সর্বজনীন। ভালোবাসা সব মানুষের মধ্যে বিরাজ করে কম-বেশি। এর বহিঃপ্রকাশ একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। ভালোবাসা নির্ভর করে মানুষের চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভূতির ওপর। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভূতির মিল না হলে সেখানে ভালোবাসার সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় না। সম্পর্ককে সঠিকভাবে লালন করার ওপর ভালোবাসার স্থায়িত্ব নিহিত। ভালোবাসার সম্পর্ককে সম্মান করতে হবে। যে কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সম্মানবোধ প্রয়োজন। সম্পর্ককে সম্মান দিতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে। সে যে সম্পর্কের ভালোবাসাই হোক না কেন। ভালোবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ অনেকাংশে ভূমিকা রাখে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সম্পর্কে জড়িত সবাইকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে হয়।
দেশকে ভালোবাসাও এক ধরনের ভালোবাসা। দেশকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে নিজ নিজ পরিসর থেকে পালন করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের কাছে তার দেশ মাতৃসম। দেশমাতাকে ভালোবাসা সব নাগরিকের দায়িত্ব। যে দেশের জনগণের মধ্যে তাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ যত বেশি সে দেশ তত উন্নত। দেশের প্রতি ভালোবাসা বা দেশপ্রেম না থাকলে সে দেশ উন্নত হতে পারে না। দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা। দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য সবার মধ্যেই থাকতে হবে। এ ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে হবে।
মন্তব্য করুন