ভারতীয় উপমহাদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৪৬ সালের মে মাসে ব্রিটিশ সরকার এ দুই দলসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতে তিন সদস্যবিশিষ্ট কেবিনেট মিশন পাঠায়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা সত্ত্বেও ভারত শাসন বিষয়ে কোনো ত্রিপক্ষীয় মতৈক্য না হওয়ায় কেবিনেট মিশন একতরফাভাবে তাদের প্রস্তাব ঘোষণা করে।

এই প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় বা ফেডারেল চরিত্রের একটি ভারতীয় ইউনিয়ন গঠিত হবে, যার হাতে বিদেশ নীতি, দেশ রক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে এবং এই বিভাগগুলোর জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকবে। এই প্রস্তাবে দেশীয় রাজ্যগুলোসহ ব্রিটিশ ভারতকে এ, বি, সি- এই তিন ভাগে বিভক্ত করার কথা বলা হয়। এক ভাগে থাকবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বোম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্ত প্রদেশ (উত্তর প্রদেশ), বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা এবং দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল। অন্য দুই ভাগের মধ্যে একটি গঠিত হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান। অন্যটি হবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা এবং আসামকে নিয়ে গঠিত। কিছু শর্তসাপেক্ষে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে কংগ্রেস সম্মত না হলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই সংবিধান সভায় যোগ দিতে সম্মত হয়। অবশেষে কংগ্রেস-লীগের দ্বন্দ্বের একটা সমাধান হলো মনে করে সাধারণভাবে ভারতের ব্যাপক জনগণ ভারত শাসন বিষয়ে এ পরিকল্পনাকে সমর্থন করে।

এর ঠিক পরই ভারতের রাজনীতি আবার সংকটজনক হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পর জওহরলাল নেহরু কংগ্রেসের নতুন সভাপতি নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পরপরই তিনি আকস্মিকভাবে ঘোষণা করেন, সংবিধান সভায় যোগদান ছাড়া প্রদেশগুলোর গ্রুপিংসহ অন্য কোনো বিষয়ে তাঁদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সংবিধান সভায় তাঁরা প্রতিটি ইস্যুতে তাঁদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটির কোনো বৈঠকি সিদ্ধান্ত ছাড়াই নেহরু একতরফাভাবে এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে গান্ধী বা বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনা করেছিলেন বলে কোথাও উল্লেখ নেই। এ ঘোষণার পর মৌলানা আজাদ পরে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও (বিবরণের জন্য তাঁর 'ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম' নামে স্মৃতিকথা) গান্ধী, প্যাটেল প্রমুখ সর্বোচ্চ কংগ্রেস নেতা নীরব থেকে নেহরুকে সমর্থন করেছিলেন।

স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম লীগের মধ্যে নেহরুর এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এর প্রতিবাদে জিন্নাহ বোম্বাইয়ে মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভা আহ্বান করেন। পাকিস্তান দাবিতে ফেরত গিয়ে ঘোষণা করেন- পাকিস্তানই ভারতের রাজনৈতিক সংকটের একমাত্র সমাধান। মুসলিম লীগের মধ্যে যে এই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হবে, এটা জওহরলাল নেহরুর ভালোই জানা ছিল। কাজেই এ পর্যায়ে মুসলিম লীগ নয়; কংগ্রেসই পাকিস্তানকে ভারতের রাজনীতিতে আবার ফিরিয়ে আনল।

বস্তুত পক্ষে এ পর্যায়ে মুসলিম লীগের থেকে কংগ্রেসই জোরেশোরে ভারত ভাগের জন্য দাঁড়াল। এর পেছনে ছিল বিড়লা, টাটার মতো বড় পুঁজির মালিক। গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ ওপরতলার কংগ্রেস নেতার ওপর বিড়লার প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ সুনীতি কুমার ঘোষ তাঁর 'ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য রাজ' এবং 'বঙ্গ বিভাজনের অর্থনীতি রাজনীতি' নামক বইয়ে এ বিষয়ে বিপুল তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করেছেন। এই পর্যায়ে প্যাটেলের ভূমিকা প্রসঙ্গে মৌলানা আজাদ তাঁর উপরোক্ত স্মৃতিকথায় লিখেছেন, এ সময় দেশভাগের পতাকা হাতে জিন্নাহ নন; সরদার বল্লভভাই প্যাটেলই রাজনীতিতে তোলপাড় করছিলেন। এ সবই পরিচিত ইতিহাস। দেশভাগ অপরিহার্য হলো।

মুসলিম লীগ ভারত ভাগের দাবি করেছিল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। এ পর্যায়ে তার সঙ্গে যুক্ত হলো সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে কংগ্রেসের বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের দাবি। দেশভাগের এই 'সংগ্রাম'-এর মস্ত এক নায়ক হিসেবে অবতীর্ণ হলেন হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তাঁর দাবি হলো, ভারত যদি অখণ্ড থাকে, তাহলেও বাংলা ভাগ করতে হবে। স্বাধীন ভারতের মন্ত্রিসভা যদিও কোনো কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা ছিল না; তা সত্ত্বেও জওহরলাল নেহরু হিন্দু মহাসভার এই সমর্থনের স্বীকৃতি ও প্রতিদানস্বরূপ তার সভাপতি, বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য করলেন!

ব্রিটিশ সরকার তাদের কলকাঠি নেড়ে ভারতবর্ষ বিভক্ত করে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ব্যবস্থা করল। প্রতিষ্ঠিত হলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং তথাকথিত ধর্মবিযুক্ত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভারত। এ চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন নেহরুর মাধ্যমে কংগ্রেসের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। নেহরু ও কংগ্রেসের সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও রাজনৈতিক লেনদেনের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের স্বাধীনতার পর তাঁকে প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়েছিল।

পাকিস্তান প্রস্তাবে ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিমে দুই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে নিয়ে দুটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যালঘু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দুটি পৃথক রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল।

সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পূর্ব বাংলায় সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানরা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় উচ্চ বর্ণ, জমিদার ও মধ্য শ্রেণির হিন্দুরা মুসলমান শাসনের অধীনে বসবাস অসম্ভব মনে করে ১৯৪৭ সালের জুন মাস থেকেই দলে দলে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে থাকল। যে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বকে ভিত্তি করে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা দাঁড়িয়েছিল; তার অবসান হলো। যে দ্বন্দ্ব থেকে সাম্প্রদায়িকতা রস সংগ্রহ করত, সে রস শুকিয়ে যেতে থাকায় সাম্প্রদায়িকতাও পূর্ব বাংলার সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি ক্ষেত্রে তার প্রাসঙ্গিকতা দ্রুত হারাতে থাকল।

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এভাবে রাজনীতিতে তার প্রাসঙ্গিকতা ও গ্রাহ্যতা হারাতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলায় নতুন ধরনের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো। এই দ্বন্দ্বের একদিকে থাকল পূর্ব বাংলার জনগণ; অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি, যা গঠিত হয়েছিল বড় পুঁজি ও ভূস্বামীদের দ্বারা। ভাষা, জাতি, অঞ্চল, সংস্কৃতি ইত্যাদি দ্বারা দ্বিধাবিভক্ত পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির লোকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের স্থলাভিষিক্ত হলো। সমাজভূমিতে দ্বন্দ্বের এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে থাকল পূর্ব বাংলার জনগণের জীবনের সর্বক্ষেত্রে। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং জনগণের রাজনৈতিক চিন্তার অসাম্প্রদায়িকীকরণ।


বিস্ময়ের ব্যাপার যে, ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের আগে একদিকে যেমন হিন্দু জমিদার ও মধ্য শ্রেণির লোকদের দেশত্যাগ শুরু হয়; তেমনি ঢাকায় শুরু হয় ছোট আকারে হলেও মুসলিম লীগের বামপন্থি নামে পরিচিত কিছু কর্মী এবং সেই সঙ্গে মুসলিম লীগের বাইরে থাকা কর্মীদের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক নতুন সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা। এ ধরনের সংগঠনের মধ্যে ছিল 'গণ আজাদী লীগ' ও 'গণতান্ত্রিক যুব লীগ'। গণতান্ত্রিক যুব লীগ ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় প্রগতিশীল যুবকদের একটি সম্মেলন করেছিল। এ ছাড়া তাদের কোনো উল্লেখযোগ্য তৎপরতা ছিল না।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন ভাষার দাবিতে শুরু হলেও সেটা ছিল মুসলিম লীগ সরকারবিরোধী এক বিশাল গণতান্ত্রিক আন্দোলন; জনগণের এক অভ্যুত্থান। সে আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় ব্যাপার বা সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটা অবশ্যই বলা দরকার, ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাংলায় শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতি নয়; সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিরও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল।

এই আন্দোলন মুসলিম লীগের শুধু রাজনীতি নয়; লক্ষ্য-আদর্শকেও বাতিল করেছিল। এর পরিণতিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। পূর্ব বাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগ তার রাজনীতি ও সংগঠন নিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। এই আন্দোলনের প্রভাবেই নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চার এক জাগরণ শুরু হয়েছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিল্প, কাব্য, সাহিত্য, সংস্কৃতিচর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। এ অবস্থা ১৯৪৭ সালের আগে ছিল অভাবনীয়। পরিবর্তনের এ ধারাকেই আমি একটি রচনায় আখ্যায়িত করেছিলাম 'মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন' বলে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এটা স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছিল- পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এ কারণে ১৯৫৫ সালে 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছিল 'আওয়ামী লীগ'। ১৯৬০-এর দশক ছিল এ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়। এ সময় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কৃষক ও শ্রমিক এলাকায় ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। মওলানা ভাসানী এসব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নেতৃত্ব দেন। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।

১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফা দাবি উপস্থিত করে। এ দাবি মূলত পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক পাকিস্তান সরকারের থেকে অর্থনীতি ক্ষেত্রে এমন কিছু দাবি আদায় করা, যার প্রধান ফলভোগী হতো পূর্ব বাংলার উঠতি মধ্য শ্রেণি। তার মধ্যে গণতান্ত্রিক উপাদান বিশেষ ছিল না। তবে সেই দাবির সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তা ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকারের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় বিকশিত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও রূপরেখা সম্পর্কে কারও বিশেষ কোনো ধারণা না থাকলেও এর মধ্য দিয়ে জনগণের চেতনায় একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ দেখা দিয়েছিল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, সে আন্দোলন ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এর পর থেকে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালে একটি সাধারণ নির্বাচনের পরও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বদলে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার এ দেশের জনগণের ওপর '৭১-এর ২৫ মার্চ এক সর্বাত্মক সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শেষে এখানে পাকিস্তানি শাসন উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত হয় এক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।

এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। কারণ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই বহুজাতিক রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ কার্যত এক-জাতিক রাষ্ট্র। এখানে সাঁওতাল, গারো, মুণ্ডা, মূর্বা, চাকমা, ত্রিপুরা, উর্দুভাষী অবাঙালি ইত্যাদি ৪০টি জাতিসত্তা থাকলেও বাঙালি হলো বিপুল সংখ্যাধিক্য। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশকে ঘোষণা করা হলো ধর্মবিযুক্ত বা 'সেক্যুলার' রাষ্ট্র। ধর্মবিযুক্ততাকে সংবিধানে ঘোষণা করা হলো রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি এবং স্তম্ভ হিসেবে।

এখানে গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখা দরকার, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন কোনো নীতি নির্ধারিত হতে পারে না, যার ভিত্তি সমাজভূমিতে নেই। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব বাংলার অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের প্রাধান্যের অবসান ঘটা, মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপিত হওয়া এবং তার ফলে রাজনীতির অসাম্প্রদায়িকীকরণ হতে থাকার কারণে সমাজভূমিতে সাম্প্রদায়িকতার প্রাসঙ্গিকতা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই পূর্ব বাংলায় এক স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রের শর্ত সৃষ্টি হয়। জনগণের রাজনৈতিক চেতনা থেকে ধর্মীয় রাষ্ট্র ও সাম্প্রদায়িকতা বহিস্কৃত হয় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে এই পরিবর্তন স্বীকৃত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মধ্যে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত হয় যাদের দ্বারা, তারা পূর্ব বাংলায় ছিল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী- উকিল, মোক্তার, প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, ক্ষুদ্র দোকানদার, নিম্নস্তরের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তারা কোনো বড় জমি ও বড় শিল্প ব্যবসার মালিক ছিল না। কাজেই ক্ষমতাসীন হয়ে তারা উৎপাদনের পরিবর্তে ব্যাপক আকারে লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধনসম্পদ অর্জন করতে থাকে। এভাবেই এক লুণ্ঠনজীবী শ্রেণি অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে গঠন করে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সালের মধ্যে এভাবে যে শাসক শ্রেণি নিজেকে সংহত করে, তারাই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করছে।

এই শাসক শ্রেণির চরিত্র সাম্প্রদায়িক না হলেও দেখা যায়, ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজন হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করতে থাকে। শুধু তাই নয়, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে 'শত্রু সম্পত্তি আইন' করা হয়েছিল; স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার তা বাতিলের বদলে নতুন নামকরণ করে 'অর্পিত সম্পত্তি আইন'। এই আইনের স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের সম্পত্তি দখল। এই সম্পত্তি দখলের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে উর্দুভাষী মুসলমানদের সম্পত্তিও ব্যাপকভাবে দখল করে তাদের প্রায় সমগ্র অংশকে রাস্তায় বসানো হয়েছিল। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন অনেক লোকের সম্পত্তির ওপরেও হামলা হচ্ছিল। হিন্দুদের সম্পত্তির ওপর যে হামলা শুরু হয়েছিল, তার চরিত্রও ছিল একই রকম। যারা হিন্দুদের ওপর এই হামলা করেছিল, তারা সাম্প্রদায়িক কারণে তা করছিল না। করছিল লুটপাটকারী, লুণ্ঠনজীবী হিসেবে। এই লুণ্ঠনজীবীরা এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের সম্পত্তির ওপর মাঝেমধ্যে হামলা করছে। এই হামলাকে বাংলাদেশের এক ধরনের 'অসাম্প্রদায়িক' লোক সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে বাজার গরম করছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে আমি বিস্তারিতভাবে লিখেছি 'হিন্দুদের ওপর কারা হামলা করে' নামে এক প্রবন্ধে (বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর)।

বাংলাদেশ কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। এটা হলো বাঙালিদের একটি জাতীয় রাষ্ট্র। এই বাঙালিদের মধ্যে বিপুল অধিকাংশ মুসলমান হলেও প্রায় ১০ শতাংশ হিন্দু। এরাই হলো বাংলাদেশের শাসক জাতি। অন্যান্য ক্ষুদ্র অমুসলমান জাতিসত্তার সঙ্গে এখানেই হিন্দুদের পার্থক্য। বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ১০ শতাংশ হলেও চাকরিক্ষেত্রে তারা ১০ শতাংশের বেশি। উল্লেখ করা দরকার, পশ্চিম বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা ৩০ শতাংশের বেশি হলেও তাদের চাকরি ২ শতাংশের মতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামান্য সংখ্যক এ ধরনের চাকরিতে থাকলেও অন্য কোনো জাতিসত্তার লোকের স্থান এ ধরনের চাকরিতে নেই। এর কারণ, তারা বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির বাইরে। অন্যদিকে হিন্দুরা হলো বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বাংলাদেশের সমাজের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতার শর্ত বিলুপ্ত হওয়ার কারণে রাজনীতি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বলে কিছু নেই। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে কোনো সাম্প্রদায়িক প্রতিপক্ষ নেই। বাংলাদেশে ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত, সংখ্যালঘুদের মধ্যে হিন্দুদের অবস্থান সবচেয়ে উন্নত। এসব সত্ত্বেও হিন্দুদের ওপর মাঝেমধ্যে যে হামলা হচ্ছে, তাকে সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিয়ে এক শ্রেণির উগ্র অসাম্প্রদায়িকতাবাদী লোক বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে। এমনকি এরা বলছে, বাংলাদেশ আফগানিস্তান হতে যাচ্ছে! অথচ এ ধরনের হামলা সাঁওতাল, মুণ্ডা, চাকমা, ত্রিপুরা, অবাঙালি উর্দুভাষী ইত্যাদি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর আরও বেশি করে হচ্ছে।

এরা এমনভাবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কথা বলছে, যাতে মনে হবে, এই দেশ ভারতের চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক! অথচ বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল নেই, যা সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র ইত্যাদি দল সাম্প্রদায়িক নয়। হিন্দুদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো বক্তব্য ও কর্মসূচি নেই। শত্রু হিসেবে তাদের লক্ষ্যবস্তু হলো কমিউনিস্ট, গণতন্ত্রী, সব ধরনের প্রগতিবাদী। তারা হলো ধর্মীয় মৌলবাদী।

এদিক দিয়ে ভারতের অবস্থা ভয়ংকর। সেখানে এখন আছে এক সাম্প্রদায়িক হিন্দু রাষ্ট্র এবং আরএসএস ও তার ঘরানার রাজনৈতিক দল বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, শিব সেনার মতো সব বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক দল। ভারতের এই অবস্থা হঠাৎ করে হয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস ১৯৪৭ সাল থেকে যে সাম্প্রদায়িক নীতি ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করে এসেছে; বর্তমান পরিস্থিতি তারই পরিণতি। এ বিষয়ে 'কংগ্রেস থেকে বিজেপি' নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে আমি বিস্তারিতভাবে লিখেছি (ভারত প্রসঙ্গে)।

উনিশ শতক থেকে শুরু হয়ে দেড়শ বছর ধরে সাম্প্রদায়িকতা বিবর্তিত হয়ে আজ বাংলাদেশে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে বলা চলে, সাম্প্রদায়িকতা একটি রাজনৈতিক বর্গ হিসেবে এখানে শুকিয়ে গেছে। ধর্মীয় বিষয় ছাড়া এখানকার হিন্দু-মুসলমানদের সামাজিক জীবনে, মেলামেশা ও কর্মক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ বলে বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু এর থেকে মনে করার কারণ নেই, সব মানুষের চিন্তা থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্বাসিত হয়েছে। এ চিন্তাও অবাস্তব। কারণ সমাজভূমিতে পরিবর্তন হলেও উপরিকাঠামোতে ও মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন একই তালে হয় না। উপরিকাঠামোর পরিবর্তন তুলনায় ধীরগতি। এ কারণে বাংলাদেশেও কিছু মানুষের চিন্তায় সাম্প্রদায়িকতা আছে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও অনেক দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে। (সমাপ্ত)

বদরুদ্দীন উমর: লেখক ও তাত্ত্বিক; সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল