
দখল, দূষণ, ভরাট আর মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে নদীগুলো আজ মুমূর্ষুপ্রায়। এর মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রমী নদী আছে, যেগুলো তার আদি প্রাকৃতিক ধারা নিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো আছে। সেগুলোকেও অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ধ্বংসের আয়োজন শুরু হয়েছে। এ রকমই এক নদী 'নকলা'। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত এটি এক সুন্দর নদী। নকলা নদীর ওপরের অংশ অর্থাৎ দরবস্ত-কানাইঘাট সড়ক অতিক্রমের অংশ থেকে আমরিখাল পর্যন্ত ছোটকাল থেকে দেখে আসছি। 'বুরিরতল' থেকে নৌকায় করে গড়খাই পর্যন্ত অংশটুকু ভ্রমণের অনেক স্মৃতি এখনও মনে আছে। কারণ, সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের আগে সুরইঘাটসহ এক বিশাল অঞ্চলে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল এ নদী। কিন্তু ভাটির অংশ অর্থাৎ 'বুরিরতল' থেকে সুন্দ্রাকাশি ও 'বাইশ-পাবিজুরি' অংশ আগে দেখা হয়নি। এর মধ্যেই নকলা নদী পুনর্খননের খবর গণমাধ্যমে জানতে পারলাম। খবর পেলাম স্লুইসগেট নির্মাণের। স্লুইসগেট আর পুনর্খনন কাজ দেখার জন্য একদিন সাত সকালে যাত্রা করলাম চতুল বাজার থেকে ইসাবা নদীর তীর ধরে।
চতুল বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বাগরআগন গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত মেঠোপথে প্রায় ৭ কিলোমিটার পথ যাওয়া সম্ভব হলো। এরপর দিগন্তবিস্তৃত জনমানবহীন প্রান্তরে প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ হাঁটার পর বাইশ-পাবিজুরি অংশের পাশেই পেয়ে গেলাম বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মিত সেই 'স্লুইসগেট'। অনেকক্ষণ ধরে স্লুইসগেটের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করলাম। এক পর্যায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম এবং পুরোটির গঠন-কাঠামো দেখলাম মনোযোগের সঙ্গে।
স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে মূল নদী থেকে খানিকটা দক্ষিণে। মূল নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দু'প্রান্ত খুঁড়ে নদীকে নতুনভাবে কাটা নদীর ভেতর দিয়ে কৃত্রিমভাবে প্রবাহিত করা হয়েছে। নদীর যে আদি প্রাকৃতিক প্রবাহ, তার প্রায় ৫০০ মিটার বর্তমানে মরে গেছে। বিশাল হাওরে বর্ষাকালে দু'কূল উপচিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কিন্তু যে উচ্চতায় গেটটি নির্মাণ করা হয়েছে তা অনেক নিচু এবং বর্ষাকালে স্বাভাবিক যে উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়, উচ্চতা তার চেয়েও অনেক কম। নিচের অংশ আবার নদীর তলদেশ থেকে প্রায় ৫ ফুট ওপরে শুরু করা হয়েছে, যেটি পানির স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যথেষ্ট। দেখলাম, গেটের কপাটগুলো ওপরে ওঠানো অথচ শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখার জন্য এগুলো বন্ধ থাকার কথা। গেটের পূর্বদিকে দেখলাম, বানের পানির সঙ্গে ভেসে আসা অনেক কাঁটা, ডালপালা ও গাছ-গাছড়া আটকে আছে। একটি নৌকা দেখলাম আড়াআড়ি ভেঙে পড়ে আছে।
জনমানবহীন প্রান্তরে খুঁজে পেলাম কয়েকজন রাখালকে, যারা নদীর পারে মহিষ চরাতে এসেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হাওরের বিশাল প্রান্তরে এ নদীই সবার অভিভাবক। বর্ষাকালে এ নদী দিয়ে শত শত নৌযান চলাচল করে। হাওর পারের মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে নদীটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হাওরের জনমানবহীন প্রান্তরে নকলা নদীর পানিই তাদের একমাত্র ভরসা। তাদের অভিযোগ হচ্ছে, সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়ভাবে এ স্লুইসগেটটি নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো মানুষ কোনোদিন এ রকম একটি স্লুইসগেট নির্মাণের দাবিও করেনি। এখন পর্যন্ত এটি কোনো কাজেও আসেনি।
স্লুইসগেটের খানিকটা পূর্বদিকে এগোতেই দেখলাম অগোছালো খোঁড়াখুঁড়ি। নদী থেকে সামান্য মাটি তুলে এবড়োখেবড়ো করে আবার তীরেই রেখে দেওয়া হয়েছে। জানতে পারলাম, গত বছর শীতকালে খননযন্ত্র দিয়ে এ কাজ করা হয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, অনেক জায়গায় নদীর তীরের পার্শ্ববর্তী জায়গা থেকে মাটি তুলে রাখা হয়েছে। বর্ষাকালে নদীর তীর উপচিয়ে পানি যখন প্লাবনভূমিতে প্রবাহিত হয়, তখন সব মাটি আবার নদীতেই চলে গেছে। প্রায় দুই কিলোমিটার পথ এগোতেই দেখলাম, খননযন্ত্র দিয়ে নদীতে কাজ চলছে। কে কেন এসব কাজ করছে, তার জবাব হাওরের মানুষের জানা থাকার কথা নয়। তারপর জিজ্ঞাসা করলে কয়েকজন জানান, এসব কাজ সরকারি। সরকারই এসব কাজ করছে। কাজের ব্যাপারে খননযন্ত্রের চালককে পাওয়া গেলেও তিনি কোনো জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে আবার রাঙারাই গ্রামের পথ ধরে নকলা নদীতে গেলাম আরেক দিন। সেখানেও খননকাজের একই চিত্র দেখা গেল। নদীর মাটি এবড়োখেবড়ো করে দু'পাশে রাখা হয়েছে, যেগুলো প্লাবনভূমি থেকে নদীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেল, 'দেশের অভ্যন্তরে ছোট নদী-খাল ও জলাশয় পুনর্খনন (১ম পর্যায়)' প্রকল্পের আওতায় নকলা নদীতে চলছে পুনর্খনন। এ প্রকল্পের আওতায় এ নদীর ১৬ কিলোমিটার এলাকা পুনর্খনন হচ্ছে, যার জন্য ব্যয় হচ্ছে ৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। একটি প্রমত্তা সুস্থ নদীকে ভরাট দেখিয়ে পুনর্খনন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দখল আর ভরাট হয়ে যাওয়া অনেক নদীকে উপেক্ষা করে নকলা নদীকে পুনর্খননের নামে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ কাদের স্বার্থে করা হয়েছে? জনমানবহীন প্রান্তর দিয়ে বয়ে চলা নদীতে খননকাজে জবাবদিহির কোনো ভয় নেই- সে জন্যই কি এ নদীকে নির্বাচন করা হয়েছে?
বড়চতুল ইউনিয়নের উত্তর সীমানায় একটি নদী আছে যেটি কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলাকে বিভক্ত করেছে। ভারত থেকে নেমে আসা সে নদীর নাম 'হিঙ্গাইর'। দখল, দূষণ ও ভরাটে সে নদীকে মৃতপ্রায় বলা যায়। সে নদী উদ্ধার ও খননের দাবি দীর্ঘদিনের। সে নদীকে বাদ দিয়ে হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নিষ্পাপ সুস্থ নকলা নদীকে পুনর্খনন সত্যিই সন্দেহের উদ্রেক করে। অযাচিত প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের টাকা অপচয়ের এক আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে নকলা নদীর স্লুইসগেট নির্মাণ ও পুনর্খনন কাজ।
আব্দুল হাই আল-হাদী: লেখক ও পরিবেশকর্মী
মন্তব্য করুন