ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বসবে ট্রাফিক সিগন্যাল

কোটি টাকার ইউটার্ন বিফলে, ডাইভারশনে কিছুটা স্বস্তি

বিদেশি ঋণে ২৩৪ কোটি টাকার সিগন্যালে ‘লাল বাতি’

কোটি টাকার ইউটার্ন বিফলে, ডাইভারশনে কিছুটা স্বস্তি

ফাইল ছবি

 রাজীব আহাম্মদ ও বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:০৮ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১২:০২

একত্রিশ কোটি টাকার ইউটার্নে যানজট বাগে না এলেও কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে বিনা খরচের ‘ডাইভারশন’। রাজধানীর ধানমন্ডির ২৭ নম্বর, আসাদগেট, তেজগাঁও, চানখাঁরপুল এলাকার মোড়গুলোতে ডাইভারশন চালুতে বাড়তি পথ ঘুরতে হলেও কমেছে যানজটের তীব্রতা। শিগগির ফার্মগেট মোড়েও ডাইভারশন চালু হবে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করে যানজট নিরসনে কিছু মোড়ে ডাইভারশন চালু করা হয়েছে। হাইকোর্ট থেকে আবদুল্লাহপুর সড়কে পরীক্ষামূলকভাবে এটি প্রয়োগ করা হচ্ছে। সফল হলে অন্য সড়কেও প্রয়োগ করা হবে।
২০২২ সালে তেজগাঁও-আবদুল্লাহপুর সড়কে ৩১ কোটি টাকা খরচ করে ১১টি ইউটার্ন নির্মাণ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এতে যানজট আরও বেড়ে যায়। প্রায় তিন কোটি টাকা করে ব্যয়ে নির্মিত আটটি ইউটার্ন একে একে বন্ধ করা হয়। 

ডিএমপির তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর মোড়গুলোতে ট্রাফিক সিগন্যাল সংখ্যা ১১০। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় গত দু’দশকে শত শত কোটি টাকা খরচ করেও ফল শূন্য। ২০০৫ সালে ৭০ কোটি টাকায় বসানো ট্রাফিক বাতিতে কিছুদিন পর ‘লাল বাতি’ জ্বলে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১২-২৩ অর্থবছরে ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেস) প্রকল্পের আওতায় ১১২ কোটি টাকায় ২৯ মোড়ে বসানো হয় সিগন্যাল বাতি; সেগুলোও কাজে আসেনি। ২০১৬ সালে ঢাকায় বিদেশি ঋণের ৫২ কোটি টাকায় চার মোড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন হলেও একদিনও কাজে আসেনি। তাই এবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে দেশীয় প্রযুক্তিতে স্বল্প খরচে ম্যানুয়াল সিগন্যাল তৈরি করানো হয়েছে। 
গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা বুয়েটের দুই অধ্যাপকের মত নেন। যানজট নিরসনে তারা ছয় দফা সুপারিশ করেন। অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেন, সরকারপ্রধান বিনা খরচে কিংবা কম খরচে যানজটের সমাধান চান।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন সড়কে পুলিশি ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় সব রাস্তায় রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের ছয় সুপারিশের প্রথমেই ছিল, মূল সড়কে রিকশা বন্ধ করা। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান সমকালকে বলেন, মূল সড়কে রিকশা বন্ধে পুলিশ অনেকটা সফল হয়েছে। 
ডাইভারশনের বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, ভালো-মন্দ দুই ধরনেরই মতামত আসছে। যানজট কমেছে; কিন্তু কিছুটা পথ ঘুরতে হচ্ছে বলে অনেকে জানাচ্ছেন। যানজট নিরসনে আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। ফার্মগেটে সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে। সেখানে কিছু কাজ করতে হবে। তখন যানজট আরেকটু কমবে। 

যানজট কিছু কমেছে
বিজয়সরণি-তেজগাঁও ফ্লাইওভার থেকে নেমে লাভ রোড মোড়ে যানজটে আটকে থাকা নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। মহাখালীর দিক থেকে সাতরাস্তামুখী গাড়িও এই মোড়ে দীর্ঘ সময় আটকে থাকত। চার রাস্তার এই মোড়টির সাতরাস্তামুখী, বিজয়সরণিমুখী লেন বন্ধ করা হয়েছে ডাইভারশনের মাধ্যমে। বাঁ দিকের লেন খোলা রেখে সেদিক দিয়ে সাতরাস্তা ও বিজয়সরণিমুখী গাড়িতে লাভ রোড দিয়ে ঘুরিয়ে ঢাকা পলিটেকনিকের পাশ থেকে ফের মূল সড়কে উঠতে হয়। বিজি প্রেসের সামনের ইউটার্ন ঘুরে বিজয়সরণিমুখী গাড়ি যায়।
কর্তব্যরত পুলিশ উপপরিদর্শক মাসুম কায়সার বলেন, ২৩ অক্টোবর ডাইভারশন চালুর পর যানজট কমেছে। তবে সন্ধ্যার দিকে সাতরাস্তা থেকে মহাখালী ও বিজয়সরণি লেনের গাড়ি বাড়লে যানজট দেখা দিলেও রাস্তার বিপরীত পাশে হচ্ছে না। 

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউসংলগ্ন আড়ংয়ের সামনের মোড়ে দুটি সিগন্যাল বন্ধ করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চালাচ্ছে পুলিশ। এতে কিছুটা যানজট কমেছে বলে ভাষ্য চালক, যাত্রী ও পুলিশের। 
ধানমন্ডি পুরাতন ২৭ নম্বর সড়ক দিয়ে বের হয়ে যেসব গাড়ি নিউমার্কেট মুখে যেত, সেই যানবাহনকে মোড় পার হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ঘুরে আসতে হচ্ছে। ফলে ১ হাজার ৪০০ মিটার বেশি পথ চলতে হচ্ছে। অন্যদিকে, শ্যামলী থেকে নিউমার্কেটমুখী যানবাহনকে আগে আড়ংয়ের সামনের সিগন্যালে পড়তে হতো। সেটি বন্ধ থাকায় এখন ওই পথের গাড়িগুলো একইভাবে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ইউটার্ন করে যাচ্ছে। এতে একটু পথ ঘুরতে হলেও সিগন্যাল থেকে মুক্তি মিলছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বাড়তি পথ ঘুরলেও যানজট নেই।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বসুমতি পরিবহনের কাউন্টারের দায়িত্বরত অমি হাসান শান্ত বলেন, দুটি সিগন্যাল বন্ধে আসাদগেট ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকায় যানজট কমেছে।
বুধবার দুপুর ১২টার দিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে কথা হয় ভিআইপি পরিবহনের বাসচালক শাহ আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, কখনও কখনও সিগন্যালে ১৫-২০ মিনিটও বসে থাকতে হতো। দুটি সিগন্যাল বন্ধ করার কারণে সেই ভোগান্তি অনেকটা কেটেছে।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আসলাম সাগর সমকালকে বলেন, সিগন্যালের কারণে মিরপুর রোডে অনেক সময় আসাদগেট ছাড়িয়ে যেত যানজট। এখন সেখানে গাড়ি থামতে হয় না। সড়কে নতুন এই পদ্ধতিতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
হানিফ ফ্লাইওভারের চানখাঁরপুল প্রান্তে গাড়ি ওঠানামায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে ফ্লাইওভারের এই প্রান্তে যানজট অনেকটা কমেছে। সরেজমিন দেখা যায়, ফ্লাইওভারের আনন্দবাজার মুখ থেকে চানখাঁরপুল মোড় পর্যন্ত দুই লেনে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফ্লাইওভার থেকে নামার পর যে গাড়ি বকশীবাজারের দিকে যাবে, সেগুলো বাঁ লেন এবং যে গাড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের ফটকের দিকে যাবে, সেগুলো ডান লেন ব্যবহার করছে। ফ্লাইওভার থেকে নামার পর ডানে আনন্দবাজারের দিক যাওয়ার পথটি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এই সড়ক ব্যবহার করে ফ্লাইওভারে ওঠার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

চানখাঁরপুল মোড়ের দোকানি মো. সজীব জানান, তিনি ১০ বছরের বেশি সময় ব্যবসা করছেন ওই এলাকায়। চানখাঁরপুলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনায় যানজট অনেকটা কমেছে। 
এই সড়ক ব্যবহার করে সপ্তাহের পাঁচ দিন কেরানীগঞ্জে অফিসে যাতায়াত করেন– এমন একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, আগে আনন্দবাজার মুখে নামার পর ডান পাশে একুশে হলের সামনের সড়ক ব্যবহার করতেন। একই সড়ক হয়ে আবার ফ্লাইওভারে গাড়ি ওঠার কারণে নামার সময় গাড়িগুলোকে সিগন্যালে আটকে থাকতে হতো। তখন গাড়ির সারি চলে যেত ফ্লাইওভারের গুলিস্তান বরাবর। নতুন পদ্ধতির কারণে আগের চিত্র অনেকটা পাল্টেছে। চানখাঁরপুলে দায়িত্বরত পুলিশ সার্জেন্ট সিরাজুল ইসলাম জানান, আগের চেয়ে চানখাঁরপুল মুখে ফ্লাইওভারে যানজট কমেছে। 

জ্বলবে সিগন্যাল বাতি
ট্রাফিক সিগন্যালে আগে ২৩৪ কোটি টাকা জলে গেলেও হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেন, কোনো সভ্য শহরে হাতের ইশারায় গাড়ি চলতে পারে না। আবার ঢাকার মতো অতিব্যস্ত শহরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধুনিক পদ্ধতিও কাজ করবে না। তাই অটোমেটিকের পাশাপাশি ম্যানুয়াল অপশনও রাখা হচ্ছে বুয়েটের তৈরি সিগন্যালে। ঢাকার ২২ সিগন্যাল সিস্টেম ও বাতি লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, তা দেখতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট মোড়ে লাগানো হবে এই সিগন্যাল বাতি। তিনি জানান, প্রতিটি বাতি তৈরি ও ব্যবস্থাপনায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা ব্যয় হবে না। স্থাপনের কাজটি করবে সিটি করপোরেশন। এতে খুব একটা ব্যয় হবে না। অধিকাংশ মোড়ে পোল ও সংযোগ রয়েছে। 

হাদীউজ্জামান জানান, ল্যাব টেস্টে সিগন্যাল বাতির কার্যকারিতা সন্তোষজনক। আপাতত মোড়গুলোতে পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বুয়েটের একজন করে থাকবেন। তিনি পুলিশকে এর ব্যবহার শেখাবেন। পথচারীবান্ধব করে এই সিগন্যাল বাতি তৈরি করা হয়েছে। পথচারী পারাপারের সময় সব দিকের গাড়ি বন্ধ থাকবে। অন্ধরাও যেন চলতে পারেন, সে সময়ে হর্ন বাজানো হবে।
অধ্যাপক হাদীউজ্জামান বলেন, সিগন্যাল বাতি অটোমেটিক ও ম্যানুয়াল দুই পদ্ধতিতেই চলবে। গাড়ির চাপ বাড়লে পুলিশ সদস্যরা সময় নির্ধারণ করে দিতে পারবেন বাটন টিপে। আগে বাতির নিয়ন্ত্রণ থাকত সড়কে, যা রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হতো; চুরি হতো। এবার পুরো ব্যবস্থাপনাই থাকবে ট্রাফিক পুলিশের কক্ষে।
খোন্দকার নজমুল হাসান সমকালকে বলেন, দরপত্র আহ্বানসহ সিগন্যাল স্থাপনে কাজ করবে সিটি করপোরেশন। 

 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×