বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইকিউএয়ারের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ২০২০ সালের প্রথম দিকে কভিড-১৯-এর কারণে অর্থনৈতিক কার্যাবলি সীমিত থাকায় ঢাকায় বায়ুদূষণ কিছুটা কমেছিল, যদিও পরবর্তী সময়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম স্থানে তালিকাভুক্ত হয়। ঢাকা ও এর আশপাশে অবৈধ ও অপরিকল্পিত ইটভাটা, কলকারখানা ও যন্ত্রচালিত বাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ব্যাপকহারে স্থাপনা নির্মাণকাজের কারণে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দায়িত্বশীলরা এ সমস্যাকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিয়ে থাকে বিধায় দূষণ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে ঢাকা সিটির বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশই আসে ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোর ইটভাটার ক্লাস্টার থেকে। এয়ার কোয়ালিটি, অ্যাটমোস্ম্ফিয়ার অ্যান্ড হেল্‌থ জার্নালের এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ইটভাটা থেকে আসা দূষকের মধ্যে সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আসে যথাক্রমে ২৩ শতাংশ, ৩০ শতাংশ এবং ২৭ শতাংশ। গবেষণায় আরও উঠে আসে, ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন ইট তৈরি করতে ঢাকা ও এর আশপাশের ১ হাজার ইটভাটা থেকে বছরে প্রায় ২৩ হাজার ৩০০ টন পিএম ২.৫, ১৫ হাজার ৫০০ টন সালফার ডাই-অপাইড, ৩ লাখ ২ হাজার টন কার্বন মনোপাইড ও ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অপাইড নির্গত হয়।

ঢাকা ও এর আশপাশের শহরে ইটভাটাগুলো সাধারণত শীতকালে উৎপাদন চালু রাখে। এ সময় বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না বলেই বাতাসে ভাসমান দূষিত বস্তুকণা মাটিতে পড়ে না। এর ফলে বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার এ সময় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঢাকার দিকে বাতাস প্রবাহিত হয় এবং বেশিরভাগ ভাটা ওই দিকে অবস্থিত হওয়ায় ভাটায় উৎপন্ন দূষিত গ্যাস ও বস্তুকণা ঢাকা শহরের বাতাসে চলে আসে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা ও এর আশপাশে ইটভাটার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ এই সময়ের মধ্যে দেশে ইটভাটার পরিমাণ বেড়েছে ৫৯ শতাংশ। ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধু ঢাকা জেলাতেই ৪৮৭টি ইটভাটা ছিল। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ক্লাস্টারের মতো ইটভাটা বাড়ার কারণে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিষিদ্ধ সত্ত্বেও কোথাও কোথাও আবার ইট পোড়াতে কাঠের ব্যবহার দূষণ বাড়াচ্ছে। আবার ঢাকা জেলার ৫ হাজার ৬৬৯টি কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে উৎপন্ন গ্যাস ও ক্ষতিকর বস্তুকণা ঢাকার বাতাসে মিশে দূষিত করছে।

ঢাকা মহানগরীর বায়ুদূষণের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে যন্ত্রচালিত বাহন। যানবাহনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, যার ফলে বায়ুদূষণের পরিমাণও বাড়ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় নিবন্ধিত যন্ত্রচালিত বাহনের সংখ্যা ১৬ লাখের বেশি। ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস মিলিয়ে ২২ হাজারেরও বেশি গাড়ি এই তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন সময় পুরোনো গাড়ির বডি পরিবর্তন ও রঙ করে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। এই ফিটনেসবিহীন গাড়ি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় দূষণ বাতাসে ছড়ায়।

ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণকাজ বেড়ে যাওয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০টিরও বেশি মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। শুধু ঢাকাতেই মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এপপ্রেসওয়ে, এয়ারপোর্ট এপটেনশন, পূর্বাচল সিটি, বিআরটি লাইন, ফ্লাইওভারসহ আরও ছোট-বড় অনেক প্রকল্পের কাজ চলছে। তাছাড়া নগর সম্প্রসারণের কারণে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ভবন নির্মাণ তো আছেই। এসব নির্মাণকাজ থেকে উৎপন্ন ধুলাবালি, আবর্জনা, বিষাক্ত গ্যাস ও ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে মিশে বাতাস দূষিত করছে। নির্মাণকাজের জন্য ব্যবহূত ইট, বালু, সিমেন্ট ও অন্যান্য সরঞ্জাম পরিবহনের সময় তা পরিবেশে মিশছে। পাশাপাশি এ সকল এলাকায় ডিজেলচালিত মেশিন ব্যবহূত হয়, যা থেকে নানাবিধ বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশে অবমুক্ত হয়। তাছাড়া যেখানে সেখানে ছুড়ে ফেলা বর্জ্য পিষ্ট হয়ে ধূলিকণায় পরিণত হচ্ছে। ড্রেন থেকে অপসারিত ময়লা রোদে শুকিয়ে ধুলাবালিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। অনেক সময় রাস্তায় এবং প্রতিষ্ঠানের আশপাশে জমে থাকা ধুলাবালি অপরিকল্পিত এবং ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে ঝাড়ূ দেওয়া এবং ঝাড়ূ দেওয়ার পর আবর্জনা সেখানেই রেখে দেওয়ার কারণেও বায়ু দূষিত হচ্ছে।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। টু স্ট্রোক ইঞ্জিন নিষিদ্ধ করা, সিএনজি বাজারে সহজলভ্য করা, ইটের ভাটার ক্ষেত্রে গতানুগতিক পুরোনো প্রযুক্তি চালিত 'ফিপড চিমনি ক্লিন' নিষিদ্ধ করে দূষণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য 'জিগজ্যাগ সিস্টেম' চালু করা, অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান পরিচালনা, ঢাকার রাস্তায় পানি ছিটানো ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এছাড়া হাইকোর্ট বিভিন্ন সময় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে আসছে। সম্প্রতি হাইকোর্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকার অভ্যন্তরে বিভিন্ন পয়েন্ট ও রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটানোর নির্দেশ দেয়।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সময় নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণ আজও সম্ভব হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে কখনও কখনও অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা গেলেও পরবর্তী সময়ে তারা আবার ভাটা চালু করে এবং অভিযানের সংবাদ পেলে আবার আগুন নিভিয়ে চলে যায়। নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদাররা 'এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান' সঠিকভাবে অনুসরণ করছেন না। প্রকল্প এলাকায় ব্যবহূত বালু, কংক্রিট, সিমেন্ট ও আবর্জনার ট্রাক চলাচলের সময় এগুলোকে সঠিক নিয়মে আচ্ছাদন করা হচ্ছে না। আবার নির্মাণাধীন স্থাপনা এবং সেখানে ব্যবহার্য ইট, বালি, সিমেন্ট সুষ্ঠুভাবে ঢেকে রাখা হচ্ছে না। এছাড়া নির্মাণাধীন সাইটে ও এর আশপাশে দিনে দুইবার পানি ছিটানোর কথা থাকলেও তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঢাকার রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের খবর দেখতে পাওয়া যায়। আবার ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ির সংখ্যা কমানো ও গণপরিবহনের প্রতি জনগণকে আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়নি।

গতানুগতিক 'এন্ড-অব-পাইপ' পদ্ধতি থেকে বের হয়ে এসে দূষণ সৃষ্টির উৎসে প্রতিরোধ ও প্রশমন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। ইটভাটা ও যন্ত্রচালিত বাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ার গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও সংশ্নিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার অভ্যন্তরের কলকারখানাগুলো স্থানান্তর করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত গাড়ির অনুমোদন কমিয়ে মানসম্মত গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণে তদারকি আরও জোরদার করা প্রয়োজন। নিয়মিতভাবে যানবাহন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার নির্গমন পরিবীক্ষণ করতে হবে। নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি, ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠানের কাজ আরও গুরুত্বের সঙ্গে তদারকি করতে হবে এবং এর কোনোরকম ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শহরের ফাঁকা জায়গাগুলোকে সবুজায়নের আওতায় আনতে হবে। রাস্তা পরিস্কারের ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে 'রিজেনারেটিভ-এয়ার সুইপার' প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সংশ্নিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে গৃহীত কার্যক্রমের বাস্তব ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে।