ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মতামত

আহত বেলায়েত, তবু অদম্য

আহত বেলায়েত, তবু অদম্য

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেলায়েত শেখ

মাহফুজুর রহমান মানিক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২২ | ০৬:২০ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২২ | ০৬:৪৩

বেলায়েত শেখ ইতোমধ্যে পরিচিত উচ্চশিক্ষার অদম্য ইচ্ছের জন্য। এ বছর যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন, তখন তার বয়স ৫৫ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়ার সুযোগ না হলেও তিনি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে একটি বাসের ধাক্কায় তিনি আহত হন। তিনি যখন গাজীপুরের শ্রীপুরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন একটি বাসের ধাক্কায় মেরুদণ্ডের নিচের হাড়ে আঘাত পান। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় তাঁর শ্বশুর মারা যান। এরপর ১৭ দিন অসুস্থ থাকার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন।

তার ভাষায়, 'আমার পরীক্ষার সময়ে একটা না একটা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এটি আমার দুর্ভাগ্য। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি পরীক্ষা দিয়ে যাব।' ১৯৮৩ সালেও বেলায়েত শেখের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি; টাকার অভাবে নিবন্ধন করতে পারেননি। বাবার অসুস্থতার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে তাকে পরিবারের হাল ধরতে হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি আবারও এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু ওই বছর সারাদেশে বন্যার কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে তিনি চেয়েছিলেনে তার ভাই ও সন্তানরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করুক। কিন্তু কেউই তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। অবশেষে ৫০ বছরে তিনি নিজেই জিদ করে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে তিনি ৫৫ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছেন।

বেলায়েত শেখ আহত হলেও পরীক্ষা দেওয়া এবং উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বয়সসহ সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি তার এই স্বপ্ন পূরণের পথে অবিচল। সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি বলেছেন, এই বয়সে তিনি যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করছেন, সে কারণে অনেকেই তাকে নিয়ে টিটকারী করছেন। তারপরও তিনি দমে যাননি। ৫৫ বছর হলেই বা কী। তার আগ্রহ থাকলে তিনি পড়বেন। আমরা দেখেছি, সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীও উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের বাধা তুলে দেওয়ার মত ব্যক্ত করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, 'কেন বলা হচ্ছে, এই বয়সের পর আর ভর্তি হতে পারবে না? কেন বলা হচ্ছে, একবারের পর আর ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে না? কেন বলা হচ্ছে, এ ধরনের পড়ার পর আর ওই ধরনের পড়ায় যেতে পারবে না? এটি বোধগম্য নয়। আজকে কেউ আইন নিয়ে পড়ছেন, তিনি কেন কাল ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবেন না?।'

শিক্ষার বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর প্রশ্নগুলো যথার্থ। বয়সের দেয়াল থাকার কারণে হয়তো অনেকেই আজ শিক্ষার বাইরে। বেলায়েত শেখের বয়সেও যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চান এ দেয়াল তাদের জন্যও বাধা। তারপরও আমরা তার মতো মাঝে মধ্যে অদম্য কিছু মানুষকে দেখি। যারা বয়সের বাধা আর সমাজের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে শিক্ষায় নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে মাঝে মধ্যেই মা-মেয়ের কিংবা বাবা-ছেলের একত্রে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণের খবর আমরা পাই। তাদের অনেকেই বাহবা দেন আবার অনেকেই বাঁকা চোখে দেখে থাকেন। এটা সত্য, বয়সের একটা ব্যাপার আছে। একই বয়সের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে থাকলে তাদের পড়াশোনা ভালো। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই বয়সের বাধা নেই। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন সম্পদের অপ্রতুলতা ও অবকাঠামোর অভাবে সে জন্য এখানে বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারপরও যাদের অদম্য ইচ্ছে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে কিংবা প্রাইভেট একাধিক বিষয়ে পড়াশোনা করছে।

বেলায়েত শেখের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন সাধুবাদযোগ্য। শিক্ষার গুরুত্ব তিনি যেভাবে বুঝেছেন, সেভাবে প্রত্যেকের অনুধাবন গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে প্রায় প্রতিটি পরিবারই সন্তানের শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ করছে; সন্তানকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নে অনেক অভিভাবকই সন্তানের পেছনে সময় ব্যয় করছে। এটা ইতিবাচক দিক। বেলায়েত শেখ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন তার বয়সী এমন মানুষ, যারা ছোটবেলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছেন। এরপর আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারেননি কিংবা পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারেননি। স্বাক্ষরজ্ঞানটুকুও এখন তাদের নেই। তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষিত নিকটজন থেকে শিখতে পারেন। যাতে অন্তত নিজের নাম লিখতে পারেন। হিসাব করতে পারেন এবং বই-সংবাদপত্র পড়তে পারেন।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×